শিনজো আবের মতোই প্রাণঘাতী হামলার শিকার যে সকল রাষ্ট্রনায়ক-দেশনেতারা

শিনজো আবের মতোই প্রাণঘাতী হামলার শিকার যে সকল রাষ্ট্রনায়ক-দেশনেতারা

কলকাতা: রাষ্ট্রনায়ক। এই গুরুগম্ভীর শব্দটির আড়ালে লুকিয়ে বিপুল ক্ষমতা৷ একটা গোটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে চলা একজন নেতা হয়ে ওঠেন সে দেশের সূর্য৷ তবে সেই সূর্যও অস্তমিত হয়৷ কখনও বা অকালে৷ 

আরও পড়ুন- চালাতেন সাইকেল সারাইয়ের দোকান, ছেড়েছিলেন ডাক্তারির পড়া, সেই ছেলেই আজ দেশের আমলা!

আসলে পদমর্যাদার সঙ্গে শুধু ক্ষমতাই হাতে আসে না৷ সেই সঙ্গে একজন রাষ্ট্রনায়ককে পেরতে হয় অনেক চড়াই-উতরাই পথ৷ বিপুল দায়িত্বের কণ্টকপূর্ণ মুকুট চেপে বসে মাথায়। আর সেই মুকুট শিয়রে পরতে গেলে আঁচড় লাগতেই পারে। কিন্তু, কখনও আবার তা হয়ে  ওঠে প্রাণঘাতী৷ ঠিক তেমনই এক ঘটনার সাক্ষী থাকল জাপান৷ ৮ জুলাই, শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টা৷ জাপানের প্রাক্তন এবং সবচেয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে গুলি করে হত্যা করল আততায়ী৷ পুলিশের সামনে অপরাধ কুবুল করে শিনজোর হত্যাকারী টেটসুয়া ইয়ামাগামির দাবি, শিনজোর কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি। তাই তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। সেটা করেওছেন৷ 

তবে এমন ঘটনা প্রথম নয়৷ এর আগেও ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত ক্ষোভ থেকে বর্তমান বা প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়কদের হত্যা করা হয়েছে৷ শিনজো আবের মতো আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন অনেক রাষ্ট্রপ্রধান। নিরাপত্তার নিশ্ছিদ্র বেড়াজাল ভেঙে হামলাকারীরা কেড়ে নিয়েছে তাঁদের প্রাণ। শিনজো আবের মতোই প্রাণঘাতী হামলায় মৃত্যু হয়েছে যে বহু রাষ্ট্রনায়ক, দেশনেতার৷

আব্রাহাম লিঙ্কন- ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল৷ একটি থিয়েটারে মাথার পিছন দিকে গুলি করে হত্যা করা হয় আমেরিকার ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনকে৷ সন্ধে ৬টা নাগাদ তার উপর হামলা চালায় জন ওয়াইকস বুথ৷ পর দিন সকাল ৭টায় মৃত্যু হয় তাঁর৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনার পিছনে ছিল দাসপ্রথা বন্ধের আইন৷ 

মারি ফ্রাসোঁয়া সাদি কার্নট- ১৮৯৪ সালে ছুরি মেরে হত্যা করা হয় ফরাসি প্রেসিডেন্ট মারি ফ্রাসোঁয়া সাদি কার্নটকে৷ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সাত বছর তখনও পূর্ণ হয়নি তাঁর৷ কিন্তু তিনি হয়ে উঠেছিলেন তুমুল জনপ্রিয়৷ জনগনের বিপদে-আপদে যথা সময়ের পৌঁছে যেতেন প্রেসিডেন্ট কার্নট৷ এটাই ছিল তাঁর জনপ্রিয়তার মূল চাবিকাঠি৷ লোক-মুখে ফিরতে থাকে কার্নটের সততা, নীতিপরায়ণতার কথা। ১৮৯৪ সালের ২৪ জুন, একটি জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন কার্নট। সেই সময় তাঁর সামনে দিয়ে পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয় তাঁর হন্তক সাঁতে জেরোনিমো সিজেরিও৷ তদন্তে জানা যায়, এক ফরাসি নৈরাজ্যবাদীর মৃত্যুদণ্ডের প্রতিশোধ নিতেই তাঁর উপর হামলা চালানো হয়৷ 

লিওন ট্রটস্কি- লেনিনের ভাবশিষ্য মার্কসবাদী বিপ্লবী লিওন ট্রটস্কি ছিলেন রুশ বিপ্লবের প্রথম সারির নেতা। ১৯৪০ সালের ২১ অগস্ট জাইমে রেমন মার্সেডার ডেল রিয়ো নামে এক স্প্যানিশন কমিউনিস্ট কর্মী তাঁকে বরফ কাটার কুড়ুল দিয়ে হত্যা করে। তবে এর আগেও তাঁকে একাধিকবার হত্যার ছক কষা হয়েছিল৷ কিন্তু প্রতিবারই তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন৷  

মার্টিন লুথার কিং- আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট মন্ত্রী এবং আফ্রিকান-আমেরিকান মানবাধিকার কর্মী মার্টিন লুথার কিং একাধারে ছিলেন  কৃষ্ণাঙ্গদের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার গণআন্দোলনের নেতা৷ মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল, মার্টিনকে গুলি করে খুন করে জেমস আর্ল রে নামে এক শ্বেতাঙ্গ যুবক।

মহত্মা গান্ধী- নাথুরাম গডসের হাতে খুন হন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তিনি ছিলেন দেশনেতা। জাতির জনক। দেশের একটি বড় অংশের কাছে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা৷ ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, দিল্লিতে  সান্ধ্যকালীন প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে যাওয়ার সময় তাঁকে সামনে থেকে বুকে পর পর তিনটি গুলি করে হত্যা করেন হিন্দুত্ববাদী নাথুরাম গডসে। গান্ধীর নীতির বিরোধী ছিলেন তিনি৷ 

জন এফ কেনেডি- ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর, স্ত্রীর সঙ্গে হুডখোলা গাড়িতে যাওয়ার সময় গুলি করে হত্যা করা হয় আমেরিকার ৩৫ তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে৷  রাস্তার ধারে একটি বাড়ির ছ’তলা থেকে প্রেসিডেন্টের মাথা লক্ষ্য করে পর পর তিনটি গুলি চালিয়েছিল তাঁর হন্তক লি হার্ভে ওসওয়াল্ড৷ অনেকে তাঁর মৃত্যুর জন্য দলীয় অন্তর্ঘাতকেই দায়ী করেন৷ 

মুজিবুর রহমান- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে৷ ওই দিন ভোর রাতে মুজিবের ধানমণ্ডি ৩২ এর বাসভবনে হামলা চালায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সদস্যরা৷ মুজিবকে মোট ১৮টি গুলি করা হয়। হত্যা করা হয়েছিল তাঁর স্ত্রী, ভাই এবং দুই পুত্রবধূকেও।

বেনজির ভুট্টো- পাকিস্তানের প্রথম এবং একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোও প্রাণ হারিয়েছিলেন আততায়ীর হাতে। ১৯৮৮ এবং ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন ভুট্টো। মাঝে প্রায় ন’বছর তিনি ছিলেন অন্তরালে৷ ২০০৭ সালে দেশে ফেরার পর ফের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। জোরদার প্রচারও শুরু করেন৷ কিন্তু, ভোটের ঠিক দু’সপ্তাহ আগে রাওয়ালপিণ্ডিতে একটি জনসভায় গুলি করে হত্যা করা হয় ভুট্টোকে। সেই সময় বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাঁচ নামিয়ে জনতার উদ্দেশে হাত নাড়ছিলেন তিনি৷ তখন তাঁকে লক্ষ করে তিনটি গুলি চালায় এক যুবক এর পর আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায়৷ 

ইন্দিরা গান্ধী- ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন তাঁরই দুই দেহরক্ষী সতবন্ত সিং এবং বিয়ন্ত সিং-এর হাতে। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর, সকাল ৯টা ২০ মিনিট৷ সফদরজং রোডের বাসভবনের বাগান দিয়ে হাঁটছিলেন ইন্দিরা। বাড়ি থেকে এক ব্রিটিশ সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য আকবর রোডের অফিসের পথে রওনা দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। ঠিক সেই সময়েই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়৷ ইন্দিরা গান্ধী স্বর্ণ মন্দিরে অপারেশন ব্লু হান্ট চালানোর পর শিখদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল৷ তার জেরেই এই হত্যা৷

রাজীব গান্ধী- ১৯৯১ সালের ২১ মে হত্যা করা হয় ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে৷ রাজীব তখন ভোটের প্রচারে দক্ষিণ ভারতে গিয়েছিলেন। তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুমবুদুরে জনসভা ছিল তাঁর ৷ বুলেটপ্রুফ গাড়ি থেকে নেমে ডায়াসের দিকে এগোনোর সময় তাঁকে একের পর এক শুভার্থীরা মালা পরিয়ে দিচ্ছিলেন৷ তাঁর হত্যাকারী তেনমোজি রাজারত্নমও মালা হাতে এগিয়ে আসেন৷ রাজীবকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁর পা ছোঁওয়ার পরই কোমরে বাঁধা আরডিএক্স বেল্টে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটান। ছিন্নি ভিন্ন হয়ে যায় রাজীবের দেহ৷ ঘড়িতে তখন  ১০টা বেজে ১০ মিনিট৷ রাজীব গান্ধীর হত্যার নেপথ্যে তামিল উগ্রপন্থী সংস্থা এলটিটিই-র হাত ছিল বলে জানান গোয়েন্দারা।