Aajbikel

ফুটবল প্রতিভা নিয়েও পাননি পদ্ম সম্মান, ছিল অভিমান, আরও এক নক্ষত্রকে হারাল ময়দান

 | 
বলরাম

কলকাতা: ভারতীয় ফুটবল জগতে নক্ষত্রপতন৷ চলে গেলেন কিংবদন্তী ফুটবলার তুলসীদাস বলরাম৷ পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় এবং চুনি গোস্বামী আগেই চলে গিয়েছেন৷ এবার ময়দানে শূন্যতা সৃষ্টি করে পরলোকে পাড়ি দিলেন তুলসীদাস বলরাম৷ পিকে-চুনি এবং বলরাম, এই ত্রয়ী ছিলেন ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের সেরা৷ ১৯৫৬ সালে অলিম্পিক্স খেলা ভারতীয় ফুটবল দলের সদস্য ছিলেন বলরাম৷ তিনিই ছিলেন সেই দলের শেষ জীবিত সদস্য৷ সেই সময় এশিয়ার ফুটবলেও পরিচিত নাম ছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন- দীর্ঘদিনের অসুস্থতার কাছ হার, প্রয়াত প্রাক্তন ফুটবলার তুলসীদাস বলরাম

ভারতের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার বলা হত তাঁকে৷ এক সময় পিকে এবং চুনীর সঙ্গে জুটি বেঁধে একের পর  এক গোল করেছিলেন৷ তাঁরা তিনজন ছিলেন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু৷ পরপারে আবার হয়তো ফুটবল পায়ে ছুটবেন এই ত্রয়ী৷ 


১৯৩৬ সালের ৪ অক্টোবর অধুনা তেলঙ্গানার সেকেন্দরাবাদে আম্মাগুডা গ্রামে জন্ম বলরামের। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ঠিক মতো খাওয়াটুকুও জুটত না৷ মা চাননি ছেলের ফুটবল খেলুক। বরং তাঁর ইচ্ছে ছিল ছেলে সরকারি করণিকের কাজ নিয়ে নিশ্চিত জীবনের পথে পা বারক৷ যে স্বপ্ন তাঁর নিজের অপূর্ণ থেকে গিয়েছে, সেটাই পূরণ করুক ছেলে। কিন্তু ছেলের টান যে সবুজ ঘাসে৷ তাকে আটকায় কে! ছোট্ট বলরাম মায়ের কথায় আমল না দিয়ে ফুটবলেই মন দিল। স্কুল ফাঁকি দিয়ে দেদার ফুটবল খেলতে থাকল সে৷ 

তবে বেশির ভাগ সময়েই খেলতে নামত খালি পেটে। দু’বেলা, পেট ভরা খাবার জোটানোর ক্ষমতা ছিল না তাঁর মায়ের। খেলার জন্য তাঁর পায়ের নীচে বিছানো ছিল না সবুজ ঘাসের গালিচা। ছিল না বুট৷  রাবারের বল নিয়ে সমান কিংবা এবড়োখেবড়ো জমিতেই বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে ফুটবল খেলতে থাকেন বলরাম৷ তবে কোনও অজ্ঞাত কারণে ছোট্ট ছেলেটির স্বপ্নের রং ছিল সবুজ-মেরুন। ওই রঙের জার্সিই ছিল তাঁর সবচেয়ে বেশি পছন্দের৷ 

হঠাৎই এক দিন ছোট্ট বলরাম ঠিক করেন, নিজেই ফুটবল দল গড়বেন। এর জন্য চাই জার্সি৷ কিন্তু পয়সা কোথায়? সেই সময় জার্সি কিনতে প্রত্যেককে দু’টাকা করে দিতে হত। মায়ের কাছে সেই টাকা ছিল না৷ অগত্যা তিনি মিথ্যার আশ্রয় নেন। মাকে গিয়ে বলেন, স্কুলে বই কেনার জন্য টাকার প্রয়োজন৷ সে কথা শুনে মা এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে টাকা ধার করে এনে দেন তাঁকে৷ সেই টাকা দিয়ে স্বপ্নের সবুজ-মেরুন জার্সি কিনেছিলেন বলরাম। 

আর্মি কমব্যাট ফোর্সের হয়ে ফুটবল খেলা শুরু তাঁর। কিন্তু, ফুটবল জীবনের প্রথম বড় সুযোগ আসে মাত্র ১৯ বছর বয়সে। তখন ১৯৫৫ সাল। আচমকাই সৈয়দ আব্দুল রহিমের চোখে পড়ে যান তিনি৷ রহিম সাহেব তখন অধুনালুপ্ত হায়দরাবাদ ফুটবল সংস্থার সভাপতি। নীচের ডিভিশন লিগের রাইডার্স ক্লাবের হয়ে খেলতে সেকেন্দরাবাদ থেকে হায়দরাবাদে আসেন বলরাম। সেখান থেকে যোগ দেন হায়দরাবাদ সিটি পুলিশে। 

১৯৫৬ সালের সন্তোষ ট্রফির জন্যে হায়দরাবাদ দলে বলরামকে যোগ দিতে বলেন রহিম। কিন্তু অনুশীলনের জন্য প্রতিদিন সেকেন্দরাবাদ থেকে হায়দরাবাদে যাওয়ার মতো টাকা ছিল না তাঁর কাছে। রহিমই তাঁকে ১ টাকা ২৫ পয়সা দিয়ে একটি সাইকেল কিনে দেন।


সন্তোষ ট্রফিতে হায়দরাবাদের হয়ে দুরন্ত পারফরম্যান্স তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিল মেলবোর্ন অলিম্পিক্সেরর টিকিট৷ বলরামকে বেছে নেওয়া হয় ভারতীয় দলের জন্য৷ যদিও প্রতিযোগিতার বেশির ভাগ সময় তাঁকে বেঞ্চে বসেই কাটাতে হয়েছিল। 

চুনি পিকে বলকাম

বলরাম ভারতে ফেরার পর তাঁকে দলে নেওয়া ইচ্ছা প্রকাশ করে কলকাতার ক্লাব ইস্টবেঙ্গল। শুরুতে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু, রহিম সাহেব চাননি তক্ষুণি হায়দরাবাদ ছাড়ুক বলরাম। তাই সিদ্ধান্ত বদল করে তিনি হায়দরাবাদ সিটি পুলিশের হয়ে খেলার কথা জানিয়ে দেন। সেখানে থাকলে পুলিশ বিভাগে একটা সম্মানজনক কাজ নিয়ে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন বলেও আশা ছিল বলরামের। কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয় কনস্টেবলের চাকরি৷  যা বলরামের স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দেয়৷  তিনি তৎক্ষণাৎ ব্যাগ গুছিয়ে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেন৷ যোগ দেন ইস্টবেঙ্গলে৷ সেখান থেকেই তাঁর পরিচিতি৷ ক্রমেই তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার ফুটবলার৷ 


ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের হয়ে একের পর এক সাফল্য ছুঁয়েছিলেন বলরাম। তিনি খেলতেন ফরোয়ার্ড পজিশনে। তাঁর পায়ের ছন্দে লাল হলুদে শিবিরে বহু ট্রফি ঢুকেছে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল কর্তারা তাঁর খোঁজ রাখেননি৷ যা নিয়ে আজীবন অভিমান থেকে গিয়েছিল তাঁর৷ এমনকী বলরাম এও বলেছিলেন, মৃত্যুর পর যেন তাঁর মরদেহ যেন ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া না হয়। তাঁর সেই বক্তব্য ফুটবল দুনিয়ায় ঝড় তুলেছিল৷ পরবর্তীকালে বলরামকে অর্জুন পুরস্কারে সম্নানিত করা হয়েছিল। কিন্তু পদ্মশ্রী না পাওয়ার খেদ ছিল তাঁর। যা নিয়ে হতাশাও প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর কথায়৷ 


তিনি ভারতের হয়ে অলিম্পিক খেলা ফুটবল দলের সদস্য ছিলেন বলরাম। সেই সার্টিফিকেট ঝোলানো থাকত তাঁর বাড়ির দেওয়ালে৷ এক সময় পিকে এবং চুনীর সঙ্গে একসঙ্গে উচ্চারণ করা হত তাঁর নাম। ভারতের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার বলা হত তাঁকে। পিকে এবং চুনীর সঙ্গে জুটি বেঁধে নিজে বহু গোল করেছেন এবং গোল করিয়েওছেন। কাছের দুই বন্ধুকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন বলরাম। এদিন তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে শেষ হল ‘পিকে-চুনী-বলরাম’ যুগের৷ 

Around The Web

Trending News

You May like