কলকাতা: করোনার তাণ্ডবে যখন ওষ্ঠাগত প্রাণ, তখন পরম ‘বন্ধু’ হয়ে এসেছিল সে৷ কালের ফেরে সে-ই বন্ধুই এখন পরিণত হয়েছে ‘শত্রু’তে! ঘাতক হয়ে কাড়ছে শিশুদের প্রাণ! গত কয়েকদিন ধরে রাজ্যে একাধিক শিশুমৃত্যুর নেপথ্যে যে খলনায়কের নাম উঠে আসছে, সেটি অ্যাডিনো ভাইরাস৷
আরও পড়ুন- সর্দি-জ্বর হলেই অযথা অ্যান্টিবায়োটিক নয়! বার্তা দিল IMA
রাতারাতি বদলে গিয়েছে এই ভাইরাসের ভূমিকা৷ ঘাতক করোনার হাত থেকে আম আদমিকে রক্ষা করতে যে টিকাকরণ করা হয়েছিল, তা তৈরি হয়েছিল এই অ্যাডিনো দিয়েই। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে মজবুত করার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গুণের কারণেই সেই সময় বিশেষজ্ঞদের নজরে ত্রাতা হয়ে ধরা দিয়েছিল অ্যাডিনো৷ সে কারণেই করোনা টিকার ‘ভেক্টর ভাইরাস’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল অ্যাডিনোকে৷ সেই সিদ্ধান্ত যে সফল, তা করোনার বাড়বাড়ন্ত থমকে যাওয়া থেকেই প্রমাণিত। অথচ, সেই অ্যাডিনোর কপালে জুটল ‘শিশুঘাতী’ তকমা!
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যাডিনোকে ভিলেন হিসেবে প্রতিপন্ন করা হলেও, এটা ততটাও ক্ষতিকর নয়। তবে এর অসংখ্য ‘তুতো ভাইবোন’ রয়েছে৷ ফলে অ্যাডিনোর পরিবার অনেকটাই বড়। ডিএনএ ভাইরাসগুলির মধ্যে একমাত্র অ্যাডিনোই মানবদেহে নানা ধরনের রোগ তৈরি করে। এই ভাইরাসের সঙ্গে মানুষের পরিচয় বেশ পুরনো। যেমন ধরুন কনজাংটিভাইটিস৷ বাঙালির কাছে এটি জয় বাংলা, চোখ ওঠা কিংবা চোখ লাল রোগ নামে পরিচিত। এর মূলে রয়েছে অ্যাডিনো ভাইরাস। এছাড়াও টনসিলাইটিস অর্থাৎ টনসিলে সংক্রমণের জন্য দায়ী অ্যাডিনোর অপর এক স্ট্রেইন।
বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন সময় মানব দেহে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে৷ ফলে আগে থেকেই অ্যাডিনোকে চেনে মানব শরীর৷ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতাও তৈরি হয়ে গিয়েছে। এখন করোনার টিকা তৈরির সময় পরিচিত অ্যাডিনোকে ‘ভেক্টর ভাইরাস’ হিসেবে ব্যবহার করা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। কারণ আগে থেকে শরীরে যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে রয়েছে, ‘ভেক্টর ভাইরাস’ তার কার্যকারিতা কতটা হবে, তা নিয়ে সংশয় ছিল। সেই সমস্যা এড়াতেই টিকা তৈরির সময় শিম্পাঞ্জির শরীরে রোগ ছড়াতে পারে, এমন অ্যাডিনো ভাইরাস ব্যবহার করা হয়। এভাবেই তৈরি হয় অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড। পরবর্তীতে স্পুটনিক ভি সহ অন্যান্য টিকা তৈরির ক্ষেত্রেও মানব শরীরে সংক্রমণ তৈরি করে, এমন অ্যাডিনোই ব্যবহৃত হয়।
তাহলে হঠাৎ কেন জীবনদায়ী অ্যাডিনো ঘাতক হয়ে উঠল? বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, করোনা সংক্রমণের পর এমন আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে যে ভাইরাসের কথা শুনলেই আরও বেশি করে ভয় চেপে ধরছে আমাদের। তাছাড়া গত দু’বছর মাস্ক ব্যবহার করার করোনা তো বটেই অ্যাডিনো, ইনফ্লুয়েঞ্জাও অনেকটা প্রতিরোধ হয়েছে। এর থেকে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ গড়ে উঠতে পারেনি। সেই সব কারণেই প্রাপ্ত বয়স্কদের বদলে শিশুরা অধিক আক্রান্ত হচ্ছে। স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন ডিরেক্টর প্রতীপ কুণ্ডু বলেন, করোনা প্রতিরোধে বন্ধু হওয়া অ্যাডিনোই এখন শত্রুর বেশে হাজির৷ তাছাড়া মাঝে দীর্ঘ সময় সেভাবে অ্যাডিনোর সংক্রমণও দেখা যায়নি। তাই কিছুটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে। তবে বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক নয়।
অ্যাডিনো ভাইরাস একটি ডিএনএ ভাইরাস। এটির মূলত এ এবং বি, এই দুটি ভাগে বিভক্ত। এ-র প্রকোপে শিশুদের ডায়ারিয়া হয়। ‘বি’ শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার জন্য দায়ী৷ ড্রপলেট এবং ফিকাল রুটে এই সংক্রমণ হতে পারে। অ্যাডিনো প্রতিরোধে –
* ভিড় এড়িয়ে চলুন৷ সুইমিং পুলেও যাবেন না৷ করোনা প্রতিরোধের মতোই মাস্ক ব্যবহার করুন। বারে বারে হাত ধোওয়াটাও জরুরি।
* ওআরএস এবং লিকুইড ফুড বেশি করে খান৷ একটু বড় শিশুরা এই ভাইরাসে সেভাবে আক্রান্ত হচ্ছে না। হলেও সামান্য গলায় ব্যথা থাকছে৷
* চার বছরের কম বয়সি শিশুরাই এই ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। পাঁচ বছরের শিশুর মধ্যে অ্যান্টিবডি গ্রো করে যায়। তাই তাদের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হওয়ার আশঙ্কা অনেকটা কম। * অ্যাডিনোর জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে হার্ট, ব্রেন, লিভার, কিডনি। এর উপসর্গ হল শুকনো কাশি, প্রবল জ্বর, চোখ লাল হয়ে যাওয়া।
” style=”border: 0px; overflow: hidden”” title=”YouTube video player” width=”560″>