বিবস্বান বসু: ‘আমিই জিতব৷ নন্দীগ্রাম নিয়ে চিন্তিত নই, চিন্তিত গণতন্ত্র নিয়ে৷’-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! ‘দিদিমণি হেরে গিয়েছেন৷ নন্দীগ্রামের মানুষ নিঃশব্দে বিপ্লব করে দিয়েছেন৷’-শুভেন্দু অধিকারী!
গত ১৮ জানুয়ারি তেখালির সভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম আসন থেকে প্রার্থী হবেন তিনি৷ তাঁর সেই ‘মাস্টারস্ট্রোকে’র পর থেকেই রাজ্য-রাজনীতির ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে পরিবর্তনের এই ধাত্রীভূমি৷ আর শুভেন্দু অধিকারীও শেষ পর্যন্ত নিজের এই গড়েই বিজেপির প্রার্থী হওয়ায় প্রেস্টিজ ফাইটের মঞ্চ হয়ে ওঠে নন্দীগ্রাম৷ এহেন মর্যাদার যুদ্ধে শেষ হাসি কে হাসল, তা বলবে ২ মে৷ কিন্তু একটা কথা এখনই বলে দেওয়া যায়, ‘খেলা’র ফল যাই হোক, ইন্দ্রপতনের সাক্ষী থাকতে চলেছে নন্দীগ্রাম, তা সে মমতা জিতুন বা শুভেন্দু৷ সেক্ষেত্রে পরাজিত প্রার্থীর রাজনৈতিক ভাগ্য কোন খাতে গড়ায়, সেটাই নতুন আলোচনার রসদ৷
আরও পড়ুন- শাসক দলের মুখে বুথ দখলের অভিযোগ! ফিরছে শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনের স্মৃতি?
সবাইকে চমকে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রাম থেকে ভোটে দাঁড়ানোর ইচ্ছাপ্রকাশ করার পর পরই স্থানীয় বিধায়ক তথা ভূমিপুত্র শুভেন্দু হুংকার ছেড়েছিলন, ‘মাননীয়াকে যদি ৫০ হাজার ভোটে হারাতে না-পারি, তা হলে রাজনীতি ছেড়ে দেব৷’ তার পর হলদি নদী দিয়ে যেমন অনেকটা জল গড়িয়েছে, তেমনই জমজমাট প্রচার পর্বের শেষে টানটান উত্তেজনার ভোটও দেখেছে জমি আন্দোলনের এই আঁতুড়ঘর৷ এখন প্রশ্ন হল, ভোটের ফল বেরনোর পর কোন ইতিহাসের সাক্ষী থাকবে নন্দীগ্রাম? কার হার দেখবে? মমতার না শুভেন্দুর? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি পরাজিত হন, তা হলে তিনি হবেন বাংলার ইতিহাসে তৃতীয় ব্যক্তি যিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় হারের মুখ দেখবেন৷ এর আগে ১৯৬৭ সালে আরামবাগ কেন্দ্র থেকে প্রফুল্ল সেন এবং ২০১১ সালে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে হেরে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তৃণমূল অবশ্য নিশ্চিত, নন্দীগ্রাম থেকে দিদিই জিতছেন৷ তাই অন্য কোনও আসন থেকে মমতার আর দাঁড়ানোর সম্ভাবনায় জল ঢেলে দিয়েছে জোড়াফুল শিবির৷
আরও পড়ুন- গত ১০ বছর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিকল্প মুখ তৈরি করতে পারেনি বামফ্রন্ট, তা আবার প্রমাণিত!
নন্দীগ্রাম আসনের ফলাফল অনেকগুলো সমীকরণের জন্ম দিতে পারে। প্রথমত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতলেন এবং তৃণমূল কংগ্রেসও বাংলায় সরকার গড়ল। সেক্ষেত্রে শুভেন্দুর ভবিষ্যৎ খুব একটা সুখকর হবে না বলেই অনুমান। মমতা এবং অভিষেকের বিরোধিতা তিনি যে চড়া মাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন এবং দু’পক্ষের তরজা এমন জায়গায় পৌঁছেছে, সেখান থেকে কালীঘাটের দরজায় কড়া নাড়া তাঁর পক্ষে কিছুটা কঠিন। অসম্ভব অবশ্য নয়, কারণ রাজনীতিতে সবই সম্ভব। তিনিও হেরে গেলেন আর বিজেপির ভাগ্যেও বাংলার শিকে ছিঁড়ল না, এমন পরিস্থিতিতে গেরুয়া শিবিরেও শুভেন্দু আর সেই দর পাবেন বলে মনে হয় না। ২০২৪ বা ২০২৬-এর কথা যদি বিজেপি মাথায় রাখেও, তা হলেও হেরে যাওয়া ঘোড়া কতটা আদর-যত্ন পাবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। সেক্ষেত্রে শুধু মুখ পোড়া নয়, তাঁর রাজনৈতিক বানপ্রস্থের পথ প্রশস্ত হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। তবে তাঁর হার সত্ত্বেও বিজেপি যদি এরাজ্যের মসনদ দখল করে, তবে অবশ্যই শুভেন্দু সম্মানজনক পুনর্বাসন পাবেন, তা সে বাংলাতেই হোক বা দিল্লিতে৷
আরও পড়ুন- এখনও অধীর অপেক্ষা, অঙ্ক কষেই কি ‘খেলা’য় নেই কংগ্রেস হাইকম্যান্ড!
উলটো দিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল-দুইয়ের কপালেই যদি হার লেখা থাকে, তা হলে অনেকটা বড় ধাক্কার মুখোমুখি হতে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ একথা ঠিক যে, বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা ভয়ংকর, কিন্তু রাজনৈতিক জীবনের এই প্রান্তে এসে তিনি আদৌ আর কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে৷ বিশেষত, যখন তাঁর দশ বছরের শাসনে যেমন ভাবমূর্তি প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি হয়েছে, তেমনই তাঁর দলের দিকে উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগের আঙুল৷ তবে তিনি হেরে গেলেও, তৃণমূল যদি বাংলার শাসনক্ষমতা ধরে রাখে, তা হলে হয়তো পরিস্থিতি এতটা জটিল হবে না৷ সেই পরিস্থিতিতে মমতা যেমন কোনও নিরাপদ আসন থেকে জিতে এসে ফের মুখ্যমন্ত্রিত্বের গদি সামলাতে পারেন, তেমন আবার মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে ‘ভাইপো’র অভিষেক ঘটিয়ে নিজে বেছে নিতে পারেন মার্গদর্শকের পদ৷ পারিবারিক পরম্পরার এই রাজনীতিতে সিলমোহর পড়লে অবশ্য দলকে নতুন করে শক্ত বাঁধনে বেঁধে রাখার চ্যালেঞ্জ সামলাতে হতে পারে তাঁকে৷ যদিও পাঁচ বছরের জন্য আবার ক্ষমতা যেহেতু তখন তাঁর হাতে, সেহেতু তখন সম্ভবত তৃণমূল নেত্রীকে ভোট-পূর্ববর্তী পরিস্থিতির মতো কঠিন অঙ্ক কষতে হবে না৷
আরও পড়ুন- দেশ ‘বিরোধীশূন্য’ করতেই কি মমতাকে পরাস্ত করার জেদ বিজেপির?
এখন শুধু অপেক্ষা, উইকেটটা কার পড়ে? কোন মোড়ে বাঁক নেয় বাংলার রাজনীতি? পুনশ্চ: সব মহলেরই কাটা-ছেঁড়া বলছে, সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায় নন্দীগ্রামে শুধুই ভোট কাটবেন৷ তাঁর কাটা ভোট কাকে জিতিয়ে দেবে, চুলচেরা বিশ্লেষণ এখন তা নিয়েই৷ তবু যদি মিরাকল ঘটিয়ে মীনাক্ষিকে বেছে নেয় নন্দীগ্রাম, তা হলে জোড়া ইন্দ্রপতন তো ঘটবেই, ঘেঁটে যেতে পারে অনেক হিসেব-নিকেশও৷ মমতাও হারলেন, শুভেন্দুও হারলেন, এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গ রাজনীতি এমনই সন্ধিক্ষণে দাঁড়াবে যে, এখনই ওই জটিল বিন্যাসের আলোচনায় ঘাম না-ঝরানোই শ্রেয়৷