বিবস্বান বসু: বাংলার মসনদ দখলের ‘খেলা’ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে৷ ভোটযুদ্ধের প্রথম দফায় ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গিয়েছে ৩০ আসনের৷ দরজায় কড়া নাড়ছে দ্বিতীয় দফার ভোট৷ অথচ এখনও বঙ্গ নির্বাচনের ময়দানে দেখা নেই কংগ্রেসের হাইকম্যান্ডের৷ ব্রিগেডের মঞ্চে সলতে পাকানো থেকে শুরু করে পুরোদস্তুর ভোটপর্ব শুরু হয়ে যাওয়ার মাঝে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও, সংযুক্ত মোর্চার চাকা গড়াচ্ছে কংগ্রেসের ওপরমহলের ‘হাত’ ছাড়াই৷ বামেদের ডাকা ব্রিগেডে নেহাত কর্তব্যের খাতিরে বঙ্গ কংগ্রেসের পর্যবেক্ষক জিতিন প্রসাদ আর ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলের দেখা মিললেও, তার পর থেকে আর বাংলার নির্বাচনী রণাঙ্গনে পা রাখেননি দিল্লির কংগ্রেসি রাজনীতির প্রথম সারির কোনও নেতা৷ পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি ভোট হওয়া কেরল আর অসমে যেখানে প্রচারে ঝড় তুলে দিচ্ছেন রাহুল গান্ধি-প্রিয়াঙ্কা গান্ধি বঢরা স্বয়ং, সেখানে এরাজ্যে তাঁরা তো দূরস্থান, কংগ্রেসের শীর্ষমহলের আর কোনও নেতারও টিকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? বাংলার ব্যাটলে ব্যাটন কেন শুধুই অধীর-মান্নান-প্রদীপদের হাতে?
আরও পড়ুন- নন্দীগ্রামে ‘ব্যাটেল’ শুরু হওয়ার আগেই স্তব্ধ ইন্টারনেট, বেলাগাম সন্ত্রাসের ইঙ্গিত?
নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা যখন বাংলায় রীতিমতো কার্পেট বম্বিং চালাচ্ছেন, তখন জাতীয় কংগ্রেসের এই বৈরাগ্যের তল খুঁজতে গেলে ভেসে উঠছে গোটাকয়েক জল্পনা বা সম্ভাব্য যুক্তি। প্রথম যুক্তি এবং যেটা সবচেয়ে জোরালো, তা হল, বঙ্গে বামেদের সঙ্গে জোট কেরলে অস্বস্তি বাড়াতে পারে কংগ্রেসের, বিশেষত যেখানে ঈশ্বরের আপন দেশে লড়াইটা বিজেপির সঙ্গে নয়, লড়াইটা সরাসরি বামেদের উৎখাত করার৷ বাংলায় মিত্র আর কেরলে শত্রু, এই তত্ত্বটা বিরোধীদের হাতে তুলে দিয়ে মালয়ালি মুলুকে ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে চাইছে না কংগ্রেস হাইকম্যান্ড৷ তাঁদের অঙ্কে, বাংলায় লড়াইটা যেখানে শুধুই অস্তিত্বরক্ষার, সেখানে কেরলের কুর্সি দখলের স্বার্থে বিধান ভবনের সঙ্গে আপাতত প্রকাশ্য দূরত্ব বজায় রেখে চলাই শ্রেয়। বাংলায় কপ্টারের ধুলো ওড়াতে গিয়ে কেরলের জলে মাছ ধরার উদ্যোগকে মোটেই কেঁচে গণ্ডুষ করতে চাইছেন না রাজীব-তনয়৷ তাই ২০১৬-য় পার্ক সার্কাস ময়দানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আর রাহুল গান্ধি একফ্রেমে ধরা পড়লেও, এবারের আঁতাঁত চাঁদ সদাগরের বাঁ হাতে মনসা পুজো করার মতোই।
আরও পড়ুন- উন্নয়ন বনাম ধর্মীয় বিভাজন! নন্দীগ্রামে পাল্লা কোন দিকে ভারি?
দ্বিতীয় যে যুক্তির পালে যথেষ্ট বাতাস লেগেছে, তাতে সামনে আসছে, জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হিসেব করে নিশানা করার অঙ্ক৷ আঞ্চলিক নির্বাচনী রাজনীতির নিরিখে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব শাসক শিবিরকে আক্রমণ করলেও, সেই অস্ত্রবর্ষণে সরাসরি নাম লেখাতে চাইছে না সর্বভারতীয় কংগ্রেস৷ একে তো মমতার প্রতি দুর্বলতা রয়েছে দশ জনপথবাসিনীর, তার ওপর আবার ২০২৪-এ মোদি-বিদায়ের সম্ভাবনাকে জল-হাওয়া দিতে গেলে জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা থেকেই চটানো যাবে না তৃণমূল নেত্রীকে। পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন, বাংলার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে, সেটাই যখন নিশ্চিত নয়, তখন গৌণ বাংলায় মমতার চড়া বিরোধিতা করে দিল্লির আগামীর অঙ্ক খামোখা জটিল করে কী লাভ? সেই সমীকরণেই সম্ভবত নন্দীগ্রামে মমতার দুর্ঘটনার শিকার হওয়াকে ‘রাজনৈতিক ভণ্ডামি’ আখ্যা দেওয়ার পর পরই পঞ্জাবের কংগ্রেস সাংসদ রভনীত সিং বিট্টুর হাতে লোকসভার দলনেতার পদ তুলে দেওয়ার মতো খেসারত দিতে হয় অধীররঞ্জন চৌধুরীকে।
আরও পড়ুন- ‘বাংলাকে বাঁচান’! মমতা-শুভেন্দুর দ্বৈরথে ‘শিল্প বার্তায়’ আজও প্রাসঙ্গিক বুদ্ধবাবু!
আর এক অংশের মতবাদ আবার বলছে, প্রাদেশিক রাজনীতির চাহিদাকে মান্যতা দিয়ে আব্বাস সিদ্দিকির ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের (আইএসএফ) সঙ্গে হাত মেলাতে হলেও, সার্বিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টিকে পুরোপুরি হজম করতে পারেনি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস। আনন্দ শর্মার মতো প্রথম সারির নেতা আইএসএফের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা পড়ার বিরোধিতা করে অধীর চৌধুরীর রোষানলেও পড়েছেন। সংযুক্ত মোর্চার বিরোধীরা যেখানে আইএসএফকে একেবারে মৌলবাদী শক্তি বলে দাগিয়ে দিচ্ছে, সেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করা কংগ্রেসের ওপরতলা একেবারে মাখামাখির ঝুঁকি নিতে পারছে না। বরং মনে করছে, বঙ্গ রাজনীতির ছোঁয়াচ এড়ানোই বোধ হয় এখন শ্যাম ও কুল দুইই রক্ষার উপায়। ২৯৪ আসনের রফা করে ৯২ আসন বাগিয়ে নিতে গিয়েই যেখানে প্রতিপদে অস্বস্তি চোখে পড়েছে, সেখানে আর নতুন করে বিড়ম্বনার জন্ম দেওয়া কেন?
আরও পড়ুন- মুকুল রায়ের ‘প্রশংসা’ মমতার! বিজেপির দ্বন্দ্ব বাড়ানোর ছক?
কিন্তু, নাচতে নেমে ঘোমটা টেনে আদৌ কি কোনও সুবিধা করতে পারবে শতাব্দীপ্রাচীন কংগ্রেস? জলে নেমে চুল না ভেজানোর এই ফর্মুলায় হয়তো রাহুল-ব্রিগেডের সাময়িক মুখরক্ষা হতে পারে, কিন্তু কোঝিকোড় থেকে কলকাতা- পুরোটাই যখন জনমানসে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, তখন এই ভাবের ঘরে চুরি কি কোনও ডিভিডেন্ড দেবে ২৪ আকবর রোডের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের?