বিবস্বান বসু: কার দখলে বাংলা? আট দফার নির্বাচনে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পালা চলছে জোরকদমে৷ আগামী পাঁচ বছরের জন্য এরাজ্যের কান্ডারি কে হবেন, তা নির্ণয়ের যুদ্ধে যেমন বান ডেকেছে প্রতিশ্রুতির, তেমনই উত্তুঙ্গে উঠেছে বিজ্ঞাপনী প্রচার৷
আরও পড়ুন- যিনিই হারুন ইন্দ্রপতন, কোন ভবিষ্যতের সূচনা নন্দীগ্রামে?
ভোটপ্রচারের ময়নাতদন্তে উঠে আসা সাম্প্রতিকতম তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, অসম, তামিলনাড়ু ও পুদুচেরি মিলিয়ে ৮২৪ আসনের নির্বাচনে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন বাবদই খরচ হতে চলেছে আনুমানিক সর্বোচ্চ ২২০ কোটি টাকা৷ পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু ও কেরলের মতো বেশি আসনের রাজ্যেই মূলত চড়া বিজ্ঞাপনী খরচ৷ তবে পরিসংখ্যান ঘাঁটলে স্পষ্ট, দক্ষিণের দুই রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে৷ কেবল বাংলার গদি দখলের লড়াইয়েই ১২০ থেকে ১৩০ কোটি টাকা খরচ হওয়ার সম্ভাবনা৷ সেই অঙ্কও আবার মূলত দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী- তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির প্রতিযোগিতার ফসল৷ মাঠে-ময়দানে তো বটেই, তার পাশাপাশি বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম, আঞ্চলিক সংবাদপত্র ও সামাজিক মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের বিজ্ঞাপনী বিনিয়োগ সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো৷ শেষ বিচারে এই রাজসূয় উদ্যোগে লাভের গুড় ঘরে উঠবে কি না তা সময় বলবে, তবে এখনই এটা বলে দেওয়া যায় যে, খেলা যত গড়াচ্ছে, বিজ্ঞাপনী প্রচারে তৃণমূলকে গোলের মালা পরাচ্ছে বিজেপি৷ বাকিরা তো আলোচনায় আসারই ভিসা-পাসপোর্ট পাচ্ছে না৷
আরও পড়ুন- শাসক দলের মুখে বুথ দখলের অভিযোগ! ফিরছে শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনের স্মৃতি?
একথা অনস্বীকার্য, ভারতবর্ষে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বাস হলেও, ক্ষমতায় আসা ইস্তক বিজেপির একচেটিয়া প্রচারের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছে না কেউই৷ আর দিনে দিনে পদ্মের তহবিল যত ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, ততই সমানুপাতিক হারে বেড়েছে তাদের বিজ্ঞাপনী আগ্রাসন৷ এবারের বিধানসভার যুদ্ধে বাংলাও সাক্ষী থাকছে সেই আক্রমণাত্মক প্রচারের৷ আসলে বিজেপি যেহেতু এবার যেনতেন প্রকারেণ বাংলার মসনদ দখলে মরিয়া, সেখানে আর্থিক প্রশ্নে কোনও কার্পণ্যই রাখছে না তারা৷ রাখছে না কোনও বাছবিচারও। আর বিজ্ঞাপনী প্রচারে ঝড় তোলা তো তাদের একেবারে চেনা পিচে ‘খেলা’৷ কর্পোরেটের কল্যাণে বৃহৎ সর্বভারতীয় দলের ভাঁড়ার যখন উপচে পড়ছে, তখন গোলা-গুলি চালানোয় খামতি রাখার প্রশ্ন কোথায় উঠছে!
আরও পড়ুন- গত ১০ বছর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিকল্প মুখ তৈরি করতে পারেনি বামফ্রন্ট, তা আবার প্রমাণিত!
বিজ্ঞাপনী যুদ্ধে তৃণমূল অবশ্য শুরুটা মন্দ করেনি৷ ‘বাংলার গর্ব মমতা’ থেকে শুরু করে ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’, রাজ্যের পথ-প্রান্তর ছয়লাপ হয়ে গিয়েছিল দলনেত্রীর হাসিমুখে৷ বৈদ্যুতিন মাধ্যমেও উন্নয়নের কম প্রচার করেনি জোড়াফুল শিবির৷ তবে ভোট যত দরজায় কড়া নেড়েছে, ততই স্ট্রাইক রেট বেড়েছে বিজেপির৷ আর এখন গেরুয়া প্রচার তো পুরো টি-টোয়েন্টি মেজাজে৷ সংবাদপত্রের পাতা থেকে টিভির স্ক্রিন বা সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল, শুধুই ‘আর নয় অন্যায়’, ‘আর নয় …’৷ বাংলায় ‘আসল পরিবর্তন’ আনতে কেবলই ‘এবার বিজেপি’৷ বিজ্ঞাপনী প্রচারের এই কার্পেট বম্বিংয়ে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলই যেখানে পিছিয়ে পড়েছে কয়েক ল্যাপ, সেখানে বাকি বিরোধীদের তো পতাকা-হোর্ডিংয়ের খরচ জোগাড় করতেই ভাঁড়ে মা ভবানী৷
আরও পড়ুন- এখনও অধীর অপেক্ষা, অঙ্ক কষেই কি ‘খেলা’য় নেই কংগ্রেস হাইকম্যান্ড!
অর্থ যখন কোনও বাধা নয়, প্রতিবন্ধকতা নয় নির্বাচনী মাপকাঠিও, তখন যার পকেটে যত টাকা, সে তত বিজ্ঞাপনী প্রচারে ওড়াবে তাতে না আছে কোনও ন্যায়ের প্রশ্ন, না আছে কোনও নীতির প্রশ্ন। আর বেড়াল যেমন ইঁদুরের রং দেখে না, তেমনই সব শ্রেণির সংবাদমাধ্যমও দল-মত-নির্বিশেষে বিজ্ঞাপন-ধন্য হয়ে হাল ফেরাচ্ছে তাদের অর্থনীতির, করোনা-আক্রান্ত সময়ে যা মোটের ওপর আইসিইউয়ে৷ কিন্তু একাধারে বহুদলীয়, অন্যদিকে সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশে এই একতরফা আগ্রাসন কি সুস্থ গণতন্ত্রের পক্ষেই আদৌ কোনও ভালো বিজ্ঞাপন?