মন্ত্রী-কন্যার চাকরি খারিজ থেকে মাথায় বন্দুক ঠেকালেও… ইতিহাস লিখছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়

মন্ত্রী-কন্যার চাকরি খারিজ থেকে মাথায় বন্দুক ঠেকালেও… ইতিহাস লিখছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়

কলকাতা:  হাই কোর্টের প্রতিটি এজলাসে কোনও না কোনও ইতিহাস লেখা হয়েছে৷ এমন কিছু রায় ঘোষণা হয়েছে তা মানুষের মনে গভীর দাগ কেটে গিয়েছে৷ সম্প্রতি স্কুল সার্ভিস কমিশনের একের পর এক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় এমনই কিছু রায় ঘোষণা হয়েছে, যা শোরগোল ফেলে দিয়েছে৷ দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলতে একাধিক মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়৷ এই মুহূর্তে হাই কোর্ট চত্বরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত এই বিচারপতির নাম-ই। 

আরও পড়ুন- পাখির চোখ পঞ্চায়েত, বিজেপির প্রস্তুতি নিয়ে অবাক মন্তব্য সুকান্তর

এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশচন্দ্র অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত থেকে শুরু করে ৭৬ বছরের প্রৌঢ়ার ২৫ বছরের বকেয়া বেতন দেওয়ার নির্দেশ— একের পর এক তাৎপর্যপূর্ণ রায়ে হাই কোর্ট পাড়ায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় অভিহিত জনগণের বিচারপতি হিসেবেই।

২০১৮ সালের ২ মে কলকাতা হাই কোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। দু’বথর পর ২০২০ সালের ৩০ জুলাই হাই কোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। বিচারপতির আসনে বসার আগে দীর্ঘ ১০ বছর আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। সেই সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলা লড়েছিলেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ন্যাশনাল ইন্সিওরেন্সের মামলা। 

তবে পেশাদার জীবনের গোড়া থেকেই আইনের সঙ্গে যুক্তি ছিলেন না অভিজিৎ। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন সরকারি চাকুরে। কিন্তু সরকারি চাকরিতে মন টেকেনি তাঁর৷ শুরু করেন  আইন নিয়ে পড়াশোনা৷  

আপাতত শিক্ষা সংক্রান্ত একাধিক মামলার বিচার চলছে তাঁর এজলাসে৷ তার আগে কোম্পানি সংক্রান্ত বিষয়ের মামলাগুলি দেখতেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। সেই সময়েও বেশ কিছু মামলায় তাঁর দেওয়া বিভিন্ন রায় নিয়ে চর্চা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে অনেকেই বলে থাকেন, আইনের ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বিচারপ্রার্থীদের সহায় হয়ে উঠেছে৷ 

বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় যে সকল তাৎপর্যপূর্ণ মামলার বিচার করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হল রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতার স্কুল শিক্ষকের চাকরি খোয়ানো৷ শুধু তাই নয় তাঁকে বেতন ফেরত দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে৷ এছাড়াও এসএসসি গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি এবং নবম-দশম নিয়োগ মামলাও রয়েছে তাঁর হাতে৷ 

বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মানবিক রায়’-এর অন্যতম নজির ছিল ৭৬ বছরের শ্যামলী ঘোষের মামলা। ৩৬ বছর লড়াই শেষে তাঁকে জয়ের হাসি উপহার দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়৷ রায় ঘোষণার পর এজলাসেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সত্তরোর্ধ্ব শ্যামলী৷  দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন অভিজিৎকে। 

এখানেই শেষ নয়, ক্যানসার আক্রান্ত শিক্ষিকার ১২ দিনের বেতন কেটে নেওয়া প্রধান শিক্ষককে পদ থেকে সরিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। একই সঙ্গে তাঁর বকেয়া ইনক্রিমেন্টও দ্রুত মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। 

মানবিকতার নজির আরও রয়েছে৷ এসএসসিতে নিয়োগের দাবিতে ধর্মতলায় আন্দোলনরত ক্যানসার আক্রান্ত সোমাকে ব্যক্তিগত ভাবে এজলাসে ডেকে পাঠিয়ে বিকল্প চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই চাকরি অবশ্য নেননি সোমা৷ কিন্তু বলেছিলেন, ‘‘স্যার, আপনি আমাদের মতো আন্দোলনকারীদের কাছে আশার আলো। এটা শুধু আমাদের লড়াই নয়, আপনিও আমাদের সঙ্গে আছেন। এটা ভেবেই আমাদের ভাল লাগছে।’’

প্রবল চাপের মুখেও তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছেন৷ সম্প্রতি তাঁর এজলাস বয়কট করেছিলেন তৃণমূলপন্থী  আইনজীবীকরা৷ তখন অভিজিৎ দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘‘মাথায় বন্দুক ধরতে পারেন। মারতে পারেন। মরতে রাজি আছি। কিন্তু দুর্নীতি দেখলে চুপ করে থাকব না। আওয়াজ তুলবই।’’
সম্প্রতি সুপ্রিমন কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়৷ জানতে চেয়েছিলেন, কেন তাঁর দেওয়া সকল রায়ে স্থগিতাদেশ দেওয়া হচ্ছে? যা আইনের ইতিহাসে নিশ্চিত ভাবেই বেনজির৷

বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে দাঁড়িয়েই সর্বসমক্ষে ক্ষমা চেয়েছিলেন রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি। আদালতের নির্দেশ মেনে পদক্ষেপের পর অবমাননার দায় থেকে মুক্ত হন তিনি। সেই মামলায় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য ছিল, ‘‘আপনাকে অপমান করার কোনও উদ্দেশ্য আদালতের নেই। কিন্তু আপনি আদালতের নির্দেশ মানেননি। তাই এই পদক্ষেপ করা হয়েছে। আপনি ল’কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তার পরও আইনকে অবহেলা করেছেন?’’ 

বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে আশার আলো খুঁজছেন  এসএসসি আন্দোলনকারীরাও৷ অনেকে তো জেলায় জেলায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় কার্যত প্রচার শুরু করেছেন, ‘বেকারের নয়নমণি বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়’। তাঁদের কথায়, অপদার্থ কমিশন ৭ বছরেও নিয়োগ দিতে পারেনি৷ তার উপর এসএসসি গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি, নবম-দশম শ্রেনীর শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি৷ সব শেষে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসেই শুরু হয়েছে দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলার কৌশল৷ একাধিক মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বারবার শিরোনামে উঠে এসেছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়৷ হাজার হাজার বিচারপ্রার্থীর আস্থা জিতে তিনি এখন নয়নের মণি৷