রামপুরহাটের হত্যাকাণ্ড কি ‘গণহত্যা’? কী মত বিশিষ্ট সমাজ-গবেষক ও বিশ্লেষকের?

রামপুরহাটের হত্যাকাণ্ড কি ‘গণহত্যা’? কী মত বিশিষ্ট সমাজ-গবেষক ও বিশ্লেষকের?

বিশেষ প্রতিবেদন: বাম আমলে রাজ্যের একাধিক জায়গায় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। তৎকালীন শাসকদল সিপিএম সেগুলিকে গণহত্যা বলে মানতেই চায়নি। ২০১১ সালে রাজ্যে শাসনক্ষতায় পালাবদলের পর এতবড় মাপের হত্যাযজ্ঞ দেখলেন রাজ্যবাসী। কী হয়েছিল বীরভূমের রামপুরহাটে?

গণহত্যা? নাকি স্রেফ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু

স্থানীয়দের বক্তব্য, বড়শাল পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধান ভাদু শেখের সঙ্গে বিরোধ ছিল দলেরই অন্য গোষ্ঠীর। সোমবার দুষ্কৃতী হামলায় ভাদু শেখের মৃত্যু হতেই শুরু হয় পাল্টা হিংসা। ভাদু শেখের দলবল বিরোধী গোষ্ঠীর লোকজনের বাড়িতে চড়াও হয়। শুরু হয় বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগের ঘটনা। এলাকায় পুলিশ পিকেট থাকা সত্ত্বেও চলে তাণ্ডব। এলাকাবাসী প্রাণভয়ে পালাতে চেষ্টা করে। অন্তত ১০-১৫টি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পরে সেইসব অগ্নিদগ্ধ বাড়ি থেকেই কমপক্ষে ১০টি পোড়া লাশ উদ্ধার হয়েছে।

আরও পড়ুন- গত দু’দশকে বাংলায় গণহত্যার বলি ৯১ জন, রামপুরহাট উস্কে দিল সেই ‘অন্ধকার’ স্মৃতি

রামপুরহাটে পোড়া লাশের মিছিল

সোমবার রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে খুন হন বড়শাল পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধান ভাদু শেখ। তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই শুরু হয় তাণ্ডব। দমকল ১০ জনের মৃত্যু হওয়ার কথা নিশ্চিত করলেও পুলিশের দাবি, মৃত্যু হয়েছে সাত জনের। পরে একজনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করে। এককাঠি এগিয়ে তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের দাবি, শর্ট সার্কিট থেকে টিভি ফেটে আগুন ধরে যায় বাড়িতে। তাতেই পুড়ে মৃত্যু হয় একই বাড়ির সাত জনের। আগ বাড়িয়ে এই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই, গ্রাম্যবিবাদের জেরেই এমনটা হয়েছে বলে দাবি করেছে তৃণমূল। কিন্তু স্থানীয়দের দাবি, ভাদু শেখের মৃত্যুর জেরেই আগুন লাগানো হয় ১০-১৫টি বাড়িতে। বোমা মারা এবং বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া তো কোনও উৎসবের বিষয় নয়, এও তো সংঘটিত হত্যারই নামান্তর। রামপুরহাটে যেটা ঘটেছে সেটা গণহত্যাই। ঘটনাকে ‘নৃশংস’ আখ্যা দিয়েছে বিরোধীরা।

আরও পড়ুন- যুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউক্রেন, ভিটে মাটি ছাড়া ১ কোটি মানুষ, শরণার্থী সংকটে ইউরোপ

গণহত্যা কাকে বলব?

গণহত্যাকে ইংরেজি বলে Mass murder। আক্ষরিকভাবে গণ শব্দের অর্থ মানুষসমষ্টি। তাদের মেরে ফেলাই গণহত্যা। কোনও একটি জায়গায় একযোগে বা অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ হত্যা করাকে গণহত্যা। মাস মার্ডারের ইংরেজি প্রতিশব্দ জেনোসাইডের উৎসও একই। গণহত্যা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঘটে, যেখানে এক বা একাধিক মানুষ অন্যদের মেরে ফেলে। প্রখ্যাত তদন্তকারী সংস্থা এফবিআই মনে করে, গণহত্যা হল সেই হত্যাকাণ্ড যখন কোনও একটা ঘটনায় চার বা তার অধিক সংখ্যক মানুষ মারা যায় এবং হত্যাকাণ্ডের মধ্যে কোনও বিরতি থাকে না।

বিশিষ্ট সমাজ-গবেষক ও বিশ্লেষকের মত

রাজ্যের বিশিষ্ট সমাজ-গবেষক, বিশ্লেষক ও লেখক দেবাশিস ভট্টাচার্যের মতে, হত্যা যে বা যারা করুক, হত্যার কারণ যাই হোক, একসঙ্গে অনেক মানুষের হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যাই বলতে হবে। রাজনীতির লোকেরা তো বিষয়টিকে ঘুরিয়ে দিতে কিংবা ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করবেই। তারা পুলিশকে প্রভাবিত করতেও চেষ্টা করবে। রাজনীতি এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে, শাসকদলের কেষ্টবিষ্টুরা যা বলবেন, পুলিশ বা দমকলকেও তাই বলতে হবে। এই হত্যাকাণ্ডে রাজনীতির রং আছে কি নেই, তার চেয়েও বড়কথা, এতগুলো মানুষের মৃত্যুর দায় কার? ঘটনার প্রকৃত কারণ খুঁজে দেখতে হবে তদন্তকারীদের।

আরও পড়ুন- দুর্ঘটনা নয়! বগটুই গ্রামে কীভাবে আগুন লাগল জানিয়ে দিল সিট

রাজ্যের উল্লেখযোগ্য গণহত্যা

রাজনৈতিক গণহত্যার কথা উঠলে পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েকটি জায়গার নাম উঠে আসে। ১৯৭০-এ বর্ধমানের সাঁইবাড়ি গণহত্যা, ১৯৭১-এর কলকাতার কাশীপুর-বরাহনগর গণহত্যা, ২৪-৩১ জানুয়ারি, ১৯৭৯ দক্ষিণ ২৪ পরগনার মরিচঝাঁপি গণহত্যা, ১৯৮২-তে বিজন সেতুতে আনন্দমার্গীদের গণহত্যা, ২৭ জুলাই ২০০০ সূচপুরে খেতমজুরদের গণহত্যা। ৪ জানুয়ারি ২০০১ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা থানার ছোট আঙারিয়ার গণহত্যা। ১৪ মার্চ ২০০৭ এবং ১০ নভেম্বরে ২০০৭ নন্দীগ্রামের গণহত্যা। ৭ জানুয়ারি ২০১১ লালগড়ের নেতাই গ্রামে চার মহিলা-সহ গ্রামবাসীদের গণহত্যা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সেই তালিকায় নাম জুড়ল ২১ মার্চ ২০২২ রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে গণহত্যার ঘটনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 − 2 =