কলকাতা: শিক্ষায় লাগামছাড়া দুর্নীতির পর্দা ভেদে মুখ পুড়েছে রাজ্যের৷ সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে চাকরি গিয়েছে স্কুলে গ্রুপ-সি’র ৮৪২ জন কর্মীর৷ এর আগে আদালতের নির্দেশে ছেঁটে ফেলা হয়েছে অবৈধ ভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকা ও গ্রুপ ডি-র কর্মচারীদের৷ দুর্নীতির ডানা ছাঁটার প্রক্রিয়াটা শুরু ২০২২ সালের ২০ মে। তাও আবার রাজ্যের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীকে দিয়ে৷ বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় তাঁকে৷ তাঁর বদলে নিয়োগ পান মামলাকারী ববিতা সরকার৷
আরও পড়ুন- ‘আপকো হিন্দি নহি আতি?’ বিচারকের প্রশ্নে অনুব্রতর উত্তর, মুচকি হাসল এজলাস
শুধু চাকরি থেকে বরখাস্ত কারই নয়, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ ছিল, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক হিসাবে চাকরির প্রথম দিন থেকে অঙ্কিতা যত বেতন পেয়েছেন, তা দু’দফায় ফেরত দিতে হবে। একই সঙ্গে বলা হয়, তিনি আর স্কুলে যেতে পারবেন না। পরবর্তীকালে একের পর এক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার শুনানিতে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী চাকরিহারা হয়েছেন৷ প্রাথমিক শিক্ষক থেকে শুরু করে নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশের শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী, চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন অবৈধরা৷ সব মিলিয়ে হাই কোর্টের নির্দেশে এ পর্যন্ত চাকরি হারানোর সংখ্যাটা ৪,৭৮৪৷
চলতি বছরের শুরুতেই কোপ পড়েছিল গ্রুপ ডি-র বেআইনি নিয়োগ পাওয়া চাকরিজীবীদের উপরে৷ ২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে এসএসসির গ্রুপ ডি-র ১,৯১১ জন কর্মী চাকরি খোয়ান। চাকরি থেকে বরখাস্ত করার পাশাপাশি তাঁদের ৩ সপ্তাহের মধ্যে চাকরি জীবনের সম্পূর্ণ বেতন ফেরতের নির্দেশ দেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। একক বেঞ্চের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যান গ্রুপ ডি-র চাকরি হারা কর্মীদের একাংশ৷ তাঁদের যুক্তি ছিল, তাঁরা কাজ করেছেন, বেতন ফেরত দেবেন কেন? ওই সওয়ালের পর তাঁদের বেতন ফেরতের নির্দেশের উপরে স্থগিতাদেশ জারি করে ডিভিশন বেঞ্চ।
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ ছিল, গ্রুপ ডি-তে ফাঁকা হয়ে যাওয়া ১,৯১১ জনের জায়গায় ওয়েটিং লিস্ট থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে এসএসসিকে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওয়েটিং লিস্ট থেকে যোগ্য প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করবে কমিশন৷ ৬ মার্চের মধ্যে নথি যাচাই করে যাতে সুপারিশপত্র দেওয়া যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে।
গ্রুপ ডি’র পরে নবম-দশম। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসুর নির্দেশে চাকরি হারাতে হয় ৬১৮ ‘অযোগ্য’ শিক্ষককে। পরে নবম-দশমের আরও ১৫৭ জন শিক্ষকের চাকরি বাতিল করা হয়।
এর পর ১০ মার্চ, অবৈধ ভাবে গ্রুপ সি’তে চাকরি পাওয়া ৮৪২ জনের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশ, ওই ৮৪২ জন কর্মী আর স্কুলে প্রবেশ করতে পারবেন না। ১১ মার্চ দুপুর ১২টার মধ্যে ৭৮৫ জনের নিয়োগপত্র বাতিল করবে পর্ষদ৷ বাকি ৫৭ জনের কাছে কোনও নিয়োগপত্রই নেই৷ তবে এঁদের বেতন ফেরত দিতে হবে কিনা, সে বিষয়ে কোনও নির্দেশ দেননি বিচারপতি৷
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের পাশাপাশি বিচারপতি বসুর এজলাসেও চাকরি বাতিলের মামলা ওঠে। চাকরি বাতিল নিয়ে তিনি সরাসরি কোনও নির্দেশ না দিলেও, এবিষয়ে এসএসসি-কেই পদক্ষেপ করতে বলেন৷ এর পরেই রুল ১৭ অনুযায়ী স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই ৬১৮ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করে। ১ মার্চ ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে ওই ৬১৮ জনের চাকরি চলে যায়।
তালিকা কিন্তু আরও দীর্ঘ৷ হাই কোর্টের নির্দেশে গঠিত বাগ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ৯৯০ জন কর্মী তাঁদের চাকরি হারান। গত বছর মে-জুন মাসে গ্রুপ ডি-র ৬০৯ জন এবং গ্রুপ সি-র ৩৮১ জনের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
অবৈধ চাকরি প্রাপকদের তালিকায় রয়েছে তৃণমূলের নেতা নেত্রীদের নামও৷ অভিযোগ, ওএমআর শিটে ৬০টি প্রশ্নের মধ্যে মাত্র ৭টি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে হটুগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলে গ্রুপ সি পদে চাকরি পেয়েছিলেন ডায়মন্ডহারবার পুরসভার কাউন্সিলার তথা জেলা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি অমিত সাহা৷ একই অভিযোগ উঠেছে হুগলি জেলা পরিষদের সদস্য তৃণমূল নেত্রী টুম্পা মেটের বিরুদ্ধেও। তিনি ২০১৮ সাল থেকে শ্রীরামপুরের রাজ্যধরপুরের নেতাজি বয়েজ স্কুলে করণিকের চাকরি করছেন। উল্লখ্য বিষয় হল, একই পদ্ধতিতে চাকরি পান বিজেপির রাজ্য নেতা দুলাল বরের মেয়ে বৈশাখী বরও৷ দুলাল বর বাগদা বিধানসভায় ২০১৬ থেকে ২১ সাল পর্যন্ত বাম-কংগ্রেস জোটের বিধায়ক ছিলেন। বাগদার তৃণমূল নেতা সঞ্জিত সর্দারের অভিযোগ, ‘দুলাল চাকরি বিক্রির মিডিল ম্যান ছিলেন।’ এ প্রসঙ্গে দুলালের পাল্টা বক্তব্য, ‘বিয়ের পর মেয়ের চাকরি হয়েছে। মেয়ে এই চাকরির জন্য যথেষ্টই উপযুক্ত ।’
” style=”border: 0px; overflow: hidden”” title=”YouTube video player” width=”560″>