বিশেষ প্রতিবেদন: ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল, তফাত দুদশকেরও বেশি সময়ের। নানুর আর রামপুরহাটের দূরত্বে কম-বেশি ৭৫ কিলোমিটারের। রাজনৈতিক পটভূমিতেও বিস্তর ফারাক। তাতে বীরভূমের রাজনৈতিক হিংসা ও গণহত্যার ধারায় তেমন ফারাক নেই। তফাত শুধু সময়ের, হানাহানি চলছেই। শাসক বদলে গেলেও জেলাবাসীর গা হিংসার কলঙ্ক ঘুচছে না কোনওমতেই। জয়দেব, চণ্ডীদাস, রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্করের স্মৃতিধন্য এই জেলায় মানুষে মানুষে হানাহানি যেন বন্ধ হতেই চাইছে না।
আরও পড়ুন- সরকারের ভাবমূর্তি খারাপ করার চেষ্টা, রামপুরহাটের ঘটনায় সরব পার্থ
তখন বাম আমল। ২০০০ সালের ২৭ জুলাই। বাইশ বছর আগের নানুর তখন সিপিএমের দুর্গ। যেকোনও নির্বাচনেই একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল সিপিএমের। সেই আমলে নানুরের সূচপুরে ১১ জন তৃণমূল সমর্থক খেতমজুর খুন হন। সেই গণহত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত হয় শাসকদল সিপিএমের লোকজন। বাম আমলে রাজ্যের একাধিক জায়গায় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। সেই হত্যাকাণ্ডগুলি থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেয় বর্তমান শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু একটুও বদলায়নি দখলদারী ও হিংসার ছবি। তার প্রমাণ মিলেছে ২১ মার্চ ২০২২ রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে গণহত্যার ঘটনায়।
আরও পড়ুন- যুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউক্রেন, ভিটে মাটি ছাড়া ১ কোটি মানুষ, শরণার্থী সংকটে ইউরোপ
২০১১ সালে রাজ্যে শাসনক্ষতায় পালাবদলের পর এতবড় মাপের হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করলেন রাজ্যবাসী। কী হয়েছে বীরভূমের রামপুরহাটে? স্থানীয়দের বক্তব্য, বড়শাল পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধান ভাদু শেখের সঙ্গে বিরোধ ছিল দলেরই অন্য গোষ্ঠীর। সোমবার দুষ্কৃতী হামলায় ভাদু শেখের মৃত্যু হতেই শুরু হয় পাল্টা হিংসা। ভাদু শেখের দলবল বিরোধী গোষ্ঠীর লোকজনের বাড়িতে চড়াও হয়। শুরু হয় বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগের ঘটনা। এলাকায় পুলিশ পিকেট থাকা সত্ত্বেও চলে তাণ্ডব। এলাকাবাসী প্রাণভয়ে পালাতে চেষ্টা করে। অন্তত ১০-১৫টি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পরে সেইসব অগ্নিদগ্ধ বাড়ি থেকেই কমপক্ষে ১০টি পোড়া লাশ উদ্ধার হয়েছে।
এই ঘটনার নেপথ্যে কী? সোজা বাংলায় তা উত্তর, ক্ষমতার আস্ফালন ও দখলের রাজনীতি। রাজ্যে ২০১১ সালে পালাবদলের অনেক আগে থেকেই রাজ্যের অন্যান্য অংশের মত বীরভূমেও জমি পেতে শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেস। তখন থেকেই এলাকার দখল ও পুনর্দখলকে কেন্দ্র করে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষের শুরু। এগারোতে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বারবার অশান্ত হয়ে উঠেছে বিভিন্ন এলাকা। এরপর দিকে দিকে বিরোধীশূন্য হয়ে পড়লে শুরু হয় শাসকদলের নিজেদের মধ্যেই শুরু হয় খেয়োখেয়ি। গুলি-বারুদের ধোঁয়া আর রক্তের গন্ধে মাঝেমধ্যেই ভরে উঠেছে বীরভূমের বাতাস।
আরও পড়ুন- গত দু’দশকে বাংলায় গণহত্যার বলি ৯১ জন, রামপুরহাট উস্কে দিল সেই ‘অন্ধকার’ স্মৃতি
বাম আমলে এ রাজ্যে অনেক গণহত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীদের পদত্যাগ চেয়েছেন। সেইসবের সাক্ষ্য রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। একইভাবে সোমবার রামপুরহাটের বগটুই গ্রামের গণহত্যার ঘটনায় সরব হয়েছে বিরোধীরা। ঘটনাকে ‘নৃশংস’ আখ্যা দিয়ে তারা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি করেছেন। সে আমলে বারবার কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের দাবিতেও সরব হয়েছেন মমতা। সেই একই অস্ত্র এবার হাতে তুলে নিয়েছে বর্তমানে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। রামপুরহাটের ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ দাবি করেছে বিজেপি। প্রবাদ আছে, History repeats itself? একে কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলা যায়?