কলকাতা: মহাপ্লাবন এসে প্লাবিত করেছিল সৃষ্টিকে৷ প্রলয়পয়োধি জলে ডুবে গিয়েছিল সব কিছু। সেই প্রলয়ের হাত থেকে সৃষ্টিকে রক্ষা করেছিলেন এক পুরুষ। তাঁর উল্লেখ রয়েছে ‘বাইবেল’-এর ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর ‘জেনেসিস’ পর্বে৷ এই মহাপ্লাবনের বর্ণনায় তিনিই প্রধান চরিত্র৷ নোয়া বা নূহ্ নামের সেই মসিহাকে আব্রাহামিক ধর্মগুলি (ইহুদি, খ্রিস্ট এবং ইসলাম) একজন নবি বা দৈবাদেশ প্রাপ্ত মানুষ হিসাবেই মনে করে।
আরও পড়ুন-বিনা চিকিৎসায় মরছে রোগী, বয়স্করা কোভিড আতঙ্কে করছেন আত্মহত্যা! চিনে ভয়ানক অবস্থা
মহাপ্রলয়ের আগে ঈশ্বরের আদেশেই এক সুবিশাল নৌকা বা আর্ক তৈরি করেছিলেন নোয়া। ওই নৌকায় যাবতীয় প্রাণীর একটি করে যুগলকে তিনি জায়গা দেন এবং সপরিবার সেই নৌকাতেই ঠাঁই নেন। কিন্তু প্রলয় শেষে সেই নৌকার কী হল? সত্যিই কি আরারত পর্বতে ভিড়েছিল নোয়ার নৌকা? এই প্রশ্ন যুগ যুগ ধরে তাড়া করেছিল মানুষকে। সুপ্রাচীন কাল থেকে মানুষ খুঁজে চলেছেন নোয়ার সেই নৌকাকে। ইতিবাসবিদরা বলছেন, খ্রিস্টীয় প্রথম শতক থেকে শুরু হয়েছিল এই অনুসন্ধানের কাজ৷
বাইবেলের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর ‘জেনেসিস’ পর্বে যে কাহিনীর উল্লেখ রয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, মহাপ্লাবন থামার পর নোয়ার নৌকা ভিড়েছিল আরারত পর্বতে৷ তবে অন্যান্য প্রাচীন ইহুদি ধর্মপুস্তগুলিতে অন্য নামের কোনও পর্বতের কথা বলা হয়েছে৷ তবে অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করেন, আরারত পর্বতেই থেমেছিল নোয়ার নৌকা৷
কিন্তু এই আরারত পর্বত কোথায়? সেটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে ওঠে অনুসন্ধানীদের কাছে। মধ্যযুগে আর্মেনিয়ার (বর্তমানে তুরস্কের অন্তর্গত ভূখণ্ড) একটি পর্বতকে আরারত বলে মনে করা হয়৷ ইহুদিদের এক প্রাচীন গ্রন্থ ‘বুক অফ জুবিলিজ’-এ বলা হয়েছে, নোয়ার নৌকা থেমেছিল লুবার নামে এক পর্বতশৃঙ্গে৷ যা আদতে আরারত পর্বতেরই একটি চূড়া।
১৬-১৭ শতকের ইংরেজ নৌসেনাপতি এবং অভিযাত্রী স্যর ওয়াল্টার ব়্যালি তাঁর ‘হিস্টোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ (১৬১৪) নামক বইয়ে উল্লেখ করেছেন, আরারত পর্বতকে শুধু মাত্র আর্মেনিয়ার একটি পাহাড় নয়, এটা এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রসারিত এক পর্বতশিরা। স্যর ব়্যালির মতে, নোয়ার নৌকার যাত্রা শেষ হয়েছিল প্রাচ্যের কোনও প্রান্তে।
খ্রিস্টধর্মের আদিপর্বেও দাবি করা হয়েছে, নোয়ার নৌকার অবশেষ হয়েছিল আর্মেনিয়ার কোনও অংশে। কিন্তু এর কোনও প্রমাণ মেলেনি। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে আর্মেনিয়ার সেন্ট জ্যাকব অফ নিসবিস নোয়ার নৌকা খোঁজার জন্য চেষ্টা চালান। জ্যাকব নাকি এক দেবদূতের দেখা পান এবং নোয়ার নৌকায় পৌঁছতে সাহায্য করেন।
সপ্তম শতকে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন হওয়ার পর নোয়ার নৌকার উপর ভিন্ন ভাবে আলোকপাত হতে থাকে৷ পবিত্র কোরান অনুসারে নূহ্ নবি বা নোয়ার নৌকা এশিয়া মাইনরের আনাতোলিয়া অঞ্চলের জুডি পর্বতে গিয়ে থেমেছিল। কোরান-এ এই পর্বতের নাম ‘কার্দু’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে।
পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বা বাইজেন্টিয়ামের সম্রাট হেরাক্লিয়াস ৬২৮ বা ৬২৯ সাল নাগাদ নোয়ার নৌকার খোঁজ শুরু করেন। আবার ইসলামি কিংবদন্তি জানায়, রাশিদুন খলিফা উমর ইবন আল-খত্তাব নিসবিসের কাছে নোয়ার নৌকার অবশেষ খুঁজে পান এবং সেই নৌকার কাঠ দিয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করান।
একাদশ শতকে শুরু হয় ক্রুসেড৷ যার হাত ধরে পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে তথাকথিত প্রাচ্যের সরাসরি যোগাযোগ ঘটে। এত দিন পর্যন্ত আর্মেনিয়ার বাসিন্দারা আরারত পর্বতে নোয়ার নৌকা থামার কাহিনিকে সত্য বলে মানতেন না। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের দ্বারা তারা প্রভাবিত হওয়ার পর আরারত পর্বতে নোয়ার নৌকা ভেড়ার গল্পটিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। তবে আরারত পাহাড়ে নৌকার খোঁজে তাঁর অভিযান চালাননি। কারণ, ধর্মীয় কারণে ওই পাহাড়ে ওঠা নিষিদ্ধ ছিল।
পরবর্তীতে বিভিন্ন খ্রিস্টীয় গ্রন্থেও এই বিষয়ে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সেই নৌকা যে আর আস্ত নেই, সে বিষয়েও খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসীরা মত প্রকাশ করেন৷
১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ অভিযাত্রী জেমস ব্রাইস মাউন্ট আরারতে অভিযান চালান এবং সেখানে ৪ ফুট লম্বা এবং ৫ ইঞ্চি পুরু এক কাঠের তৈরি কাঠামোর সন্ধান পান৷ যা তাঁর মতে প্রাকৃতিক নয়। তিনি সেটিতে নোয়ার নৌকা বা আর্ক হিসেবেই চিহ্নিত করেন এবং তার একটি টুকরো নিজের কাছে গচ্ছিত রাখেন অভিযানের স্মারক হিসেবে৷ এর পরেও বহুবার অভিযান হয়েছে৷ অনেকের মুখে উঠে এসেছে নোয়ার নৌকার কথা৷ কিন্তু, তার হদিস আজ পর্যন্ত মেলেনি। তবে সত্যই যদি কোনও মহাপ্রলয় ঘটে থাকে, তাহলে সেই আমলে কাঠ দিয়ে তৈরি কোনও নৌকার কাঠামো এত দিন টিকে থাকতে পারে না৷ এটা সম্ভব নয়৷ তাই নোয়ার নৌকা বেঁচে আছে মানুষের কল্পনায়-বিশ্বাসে-সাহিত্যে-চলচ্চিত্রে।
” style=”border: 0px; overflow: hidden”” title=”YouTube video player” width=”560″>