কলকাতা: বারাণসী থেকে ডিব্রুগড়৷ দীর্ঘ নদীপথে শুরু হয়েছে বিলাসবহুল প্রমোদরী ‘গঙ্গা বিলাস’-এর যাত্রা৷ শুক্রবার পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী ক্রুজ ‘গঙ্গা বিলাস’-এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ বারাণসী থেকে যাত্রা শুরু করে গঙ্গা পথে বিহার, ঝাড়খণ্ড পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে পৌঁছবে গঙ্গা বিলাস৷ এরপর কলকাতা থেকে তা পাড়ি দেবে বাংলাদেশের উদ্দেশে৷ সেখান থেকে পৌঁছবে অসমের গুয়াহাটিতে। ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে মোট ২৭ টি নদীর জল স্পর্শ করবে গঙ্গা বিলাস৷ মোট ৩,২০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করবে এই ক্রুজ৷ দীর্ঘ যাত্রাপথে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সব রকম বন্দোবস্ত রয়েছে৷ গঙ্গা বক্ষে ঢেউয়ের শব্দ শুনে কাটবে ৫১ দিন৷ কিন্তু, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গঙ্গাবিলাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক বিপদের পদধ্বনি৷ জাকজমকপূর্ণ এই নৌবিহারে বিপন্ন হতে পারে গাঙ্গেয় ডলফিন৷ কারণ গঙ্গা বিলাসের যাত্রাপথেই যে ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে তাদের আস্তানা৷
আরও পড়ুন- ব্রেকিং: মানিক ভট্টাচার্যকে বড় অঙ্কের জরিমানা হাইকোর্টের
আশঙ্কা করা হচ্ছে এই বৃহত্তর ক্রুজ যাত্রায় জলজ সম্পদের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে৷ যার প্রভাব পড়বে মৎস্যজীবীদের জীবন ধারণের উপড়েও৷ ভারতে অবশ্য গাঙ্গেয় ডলফিনদের সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে৷ বারাণসী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে গঙ্গা ও গোমতীর সঙ্গমে শান্ত জলরাশিতে গড়ে উঠেছে ডলফিনের নিরাপদ আবাস৷ গত অক্টোবর মাসে এই অঞ্চলে বাচ্চা সহ এক ঝাঁক ডলফিন প্রত্যক্ষ করেন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মীরা৷ তাঁদের অনুমান, দুই নদীর সঙ্গমস্থলে ৩৫ থেকে ৫৯ টি গাঙ্গেয় ডলফিন রয়েছে৷ তবে আশঙ্কার বিষয় হয়, গাঙ্গেয় ডলফিনদের এই নিরাপদ আশ্রয়স্থলের উপর দিয়েই আঁকা হয়েছে এমভি গঙ্গাবিলাস-এর যাত্রাপথ৷
বাংলাদেশের যে যে অংশের ওপর দিয়ে এই প্রমোদতরী চলাচল করবে, তার মধ্যে রয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন। সে দেশে কিন্তু অনেকটাই বিপন্ন গাঙ্গেয় ডলফিন বা স্থানীয় ভাষায় ‘শুশুক’। দেশের প্রধান নদীগুলোতে এখন তাদের দেখা মেলে কালেভদ্রে। চট্টগ্রামের হালদা নদী এবং পদ্মা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র ও এর শাখা নদীগুলোতে বাস বিশ্বের বিপন্ন গাঙ্গেয় ডলফিন ও ইরাবতি ডলফিনের৷ তবে বিভিন্ন কারণে এসব ডলফিন এখন বিলুপ্তির পথে।
ভারতের বিশিষ্ট প্রাণী সংরক্ষণবিদ রবীন্দ্র কুমার সিনহা। ১৯৯০ এর দশকে তার প্রচেষ্টাতেই গাঙ্গেয় ডলফিনের গুরুত্বপূর্ণ বিচরণক্ষেত্রগুলোকে সংরক্ষিত অঞ্চলের স্বীকৃতি দেয় তৎকালীন কেন্দ্রের সরকার। তাঁর কথায়, ‘বর্তমানে একাধিক হুমকির মুখে রয়েছে গাঙ্গেয় ডলফিন। তার ওপর নৌবিহারের আয়োজন আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে’। তিনি বলেন, জলের শব্দকম্পন ব্যবহার করে একে-অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং মাছ শিকার করে থাকে ডলফিনরা। তাদের জীবনপ্রক্রিয়া খুবই শব্দ-সংবেদনশীল। সিনহার কথায়, ‘প্রমোদতরী চলাচলের ফলে উৎপন্ন শব্দে প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তাদের জীবনচক্রের উপর।’’
সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘‘উন্নত জল এবং সংরক্ষণের উদ্যোগের কারণে সাম্প্রতি ডলফিনের সংখ্যা বেশ কিছুটা বেড়েছে৷ গঙ্গায় প্রায় ৩,২০০টি এবং ব্রহ্মপুত্রে ৫০০টি। তবে ক্রুজ পর্যটন এই সুফলগুলিকে ধ্বংস করে দিতে পারে।’’
একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সারা ভারত মৎস্যজীবী এবং ফিশারি শ্রমিক ফেডারেশন-এর সর্বভারতীয় সভাপতি দেবাশিস বর্মনও৷ তিনি এক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘তাৎক্ষণিকভাবে এই ধরনের পর্যটনের প্রভাব বোঝা যায় না। কিছুদিন যাওয়ার পর এর প্রভাব চের পাওয়া যায়৷ সুন্দরবন এলাকায় জলপথ পর্যটনের নানা প্রভাব পড়ছে।’’
তাঁর কথায়, ‘‘নদীর স্বাভাবিক গতিপথে চাপ সৃষ্টি হলে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হবেই। নতুন ক্রুজের পরিকল্পনায় এই বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখা হয়েছে কিনা স্পষ্ট নয়। পরিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্রে ক্ষতি হলে সহজে তা পূরণ করা যায় না। বহু মানুষ বিপন্ন হচ্ছেন এবং হবেন।’’
দক্ষিণ এশিয়ায় মিষ্টি জলের ডলফিনের মধ্যে দুটি প্রজাতি রয়েছে। এর একটি হল গাঙ্গেয় ডলফিন৷ যার বৈজ্ঞানিক নাম প্লাটানিস্টা গ্যাঞ্জেটিকা। আরেকটি প্রজাতি হলো সিন্ধু নদীর- প্লাটানিস্টা মাইনর৷ এদের প্রাকৃতিক অবস্থান পাকিস্তান এবং উত্তর ভারতের বিয়াস নদী। জলদূষণ, অতিরিক্ত জল উত্তোলন ও চোরাশিকারের মতো নানান হুমকির মুখে বারবার পড়তে হয়েছে গাঙ্গেয় ডলফিনকে। জেলেদের জালে জড়িয়েও অনেক সময় মৃত্যু হয় এদের। অনেক সময় স্থানীয়রা অকারণে গাঙ্গেয় ডলফিনদের হত্যা করে। তাই সংরক্ষিত প্রাকৃতিক আবাসগুলোকে রক্ষা করে এই বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিকে রক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।
” style=”border: 0px; overflow: hidden”” title=”YouTube video player” width=”560″>