সম্মুখ সমরে রাশিয়া-ইউক্রেন, এই যুদ্ধের নেপথ্য কারণ কী?

সম্মুখ সমরে রাশিয়া-ইউক্রেন, এই যুদ্ধের নেপথ্য কারণ কী?

c803f5347c28442293082b3d672edf39

কলকাতা: একের পর এক প্রতিরোধ ভেঙে ইউক্রেনের বুকে ঢুকে পড়েছে দুর্দমনীয় রুশ বাহিনী৷ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ত্রিমুখী হামলা চালাচ্ছে পুতিনের ফৌজ৷ ন্যাটো বাহিনীর হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে কেন ইউক্রেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাশিয়া? 

আরও পড়ুন- যুদ্ধের মধ্যেই বিয়ে, মধুচন্দ্রিমায় হাতে AK-47 নিয়ে নবদম্পত্তি

এই হামলার নেপথ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি কারণ৷ যার অন্যতম হল ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি৷ ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে ২০১৪ সালে ইউক্রেনে বড়সড় ইউরোপপন্থী গণ আন্দোলন গড়ে ওঠেছিল৷ সেই সময় ইউক্রেনের মসনদে ছিলেন ভিক্টর ইয়ানোকোভিচ৷ তিনি পরিচিত ছিলেন রুশপন্থী হিসাবেই৷ ক্রেমলিনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মজবুত৷ কিন্তু আন্দোলনের জোয়ারে গদি হারাতে হয় তাঁকে৷ ইয়ানোকোভিচ গদি হারাতেই ইউক্রেনের উপর রুশ প্রভাব কমতে থাকে৷ ২০১৯ সালে ইউক্রেনের মসনদে বসেন ভলোদিমির জেলেনস্কি৷ তাঁর বিদেশনীতি থেকে প্রতিরক্ষা নীতি সবটাই কিন্তু পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ ও আমেরিকা ঘেঁষা৷ শোনা যাচ্ছে, পশ্চিমের দেশগুলির সঙ্গে সামরিক জোট যাওয়ার কথাবর্তাও চলছে তাঁর৷ ইউক্রেনের উপর থেকে আমেরিকার প্রভাব খর্ব করতে জেলেনস্কি সরকারকে সরিয়ে রুশপন্থী ‘পাপেট রিজম’ বা পুতুল সরকার গড়ে তোলাই ক্রেমলিনের উদ্দেশ্য৷ 

দ্বিতীয়ত, সোভিত ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত যে দেশগুলি ছিল যেমন বালকান, ইস্তোনিয়া, লাতভিয়া, আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত না হলেও রোমানিয়া, বুলগেরিয়া এই সকল দেশগুলিতে ন্যাটো গোষ্ঠীর প্রভাব অত্যন্ত বেশি৷ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে একটা ঠাণ্ডা লড়াই রয়েছে৷ এমতাবস্থায় গড়ে তোলা হয় ন্যাটো বাহিনী৷ যাদের লক্ষ্য ছিল ইউএসএসআর-কে রোখা৷ পরবর্তী সময়ে ন্যাটো গোষ্ঠীর নিশায় চলে আসে রাশিয়ান ফেডারেশনও৷ ইউক্রেন ও রাশিয়া একই সীমান্ত ভাগ করে৷ ফলে রাশিয়া কোনও ভাবেই চাইছে না যে তাদের সীমান্তে এসে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করুক ন্যাটো বা আমেরিকান বাহিনী৷ 

যুদ্ধনীতি বলে শত্রুর কাছে এগিয়ে যাও৷ আমেরিকান বা ন্যাটো বাহিনী ইউক্রেনে এসে সামরিক ঘাঁটি, বিমান ঘাঁটি বা মিশাইল বেস তৈরি করে, তাহলে মার্কিন বম্বার বা মিসাইলগুলির নিশানায় চলে আসবে মস্কো৷ সেই সঙ্গে পুতিনের সামরিক ঘাঁটি, মিসাইল বেস, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, সেতুগুলো প্রতিপক্ষের নিশানায় চলে আসবে৷ যা কোনও ভাবেই মেনে নিতে চান না পুতিন৷ তাই তিনি ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের মদত করার নামে তিন দিন থেকে হামলা শুরু করেন৷ নাইপার নদী পর্যন্ত রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি থাকলে পশ্চিম ইউরোপ, ন্যাটো গোষ্ঠী এবং রাশিয়ার মধ্যে একটা বাফার জোন তৈরি হয়ে যাবে৷ এর ফলে ভবিষ্যতে যদি যুদ্ধ হয়ও, তাহলে তা ইউক্রেনের মাটিতেই হবে৷ যার সরাসরি প্রভাব রাশিয়ার মধ্যে পড়বে না৷ 

এই যুদ্ধের আরও একটি কারণ রয়েছে৷ সেটা হল রুশপন্থী বিদ্রোহীদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব৷ ইউক্রেনের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত ডনবাস অঞ্চলের সঙ্গে রাশিয়ার একটি ঐতিহাসিক যোগ রয়েছে৷ এই অঞ্চলের বহু মানুষ রাশিয়ান ভাষায় কথা বলেন৷ তাঁদের পূর্বপুরুষরা রাশিয়ান৷ সীমান্তের এপার ওপাড়ের একটা আবেগ রয়েছে৷ বহু মানুষই বিনা বাধায় ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যাতায়াত করেন৷ ফলে বরাবরই মস্কোর প্রতি সহানুভূতিশীল ডনবাস৷ ২০১৪ সাল থেকেই এই অঞ্চল কিয়েভের নিয়ন্ত্রণের বাইরে৷ পুতিনের আশঙ্কা, জেলেনস্কি সরকার আমেরিকা বা ন্যাটো বাহিনীর মদতে ডোনেৎস্ক ও লুহানস্ক(যাদের একত্রে ডনবাস বলা হয়)-এ সেনা অভিযান চালিয়ে তা দখল করবে৷ এবং এই জায়গাগুলো দখল করে নেওয়ার পরই সেখানে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করবে ইউক্রেন সরকার৷ যার প্রভাবিত করবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ও সুরক্ষাকে৷ তাই আত্মরক্ষার নামে আগে থেকেই শত্রুর উপর আক্রমণ হানল রাশিয়া৷ সে কারণেই তিনদিক থেকে ইউক্রেনে ঢুকে পড়েছে রাশিয়া৷ ডনবাস, বেলারুশ (রাশিয়ার বন্ধু দেশ) সীমান্ত এবং ক্রিমিয়া (ইউক্রেনের অংশ হলেও ২০১৪ সালে দখন নেয় রাশিয়া) দিয়ে ঢুকে পড়েছে রুশ বাহিনী৷ বিদ্রোহীদের মদত দিয়ে আরও একটি সরকার গড়ে তুলতে চাইছেন পুতিন৷ যারা রাশিয়ার কথামতো চলবে৷ 

এই যুদ্ধ রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে হলেও, এটা একটা বড় কূটনৈতিক খেলার অংশ৷ ইউক্রেন সেখানে বোরে৷ খেলছে রাশিয়া ও আমেরিকা৷ ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার আধিপত্য গড়ে ওঠে৷ সেই ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন পুতিন৷ ইউক্রেন দখল করে পুতিন সরাসরি এই বার্তাই দিতে চাইছেন যে, জো বাইডেন সরকার হুমকি দিলেও বন্ধু দেশের পাশে দাঁড়াতে তারা অক্ষম৷ পূর্ব ইউরোপ থেকে শুরু করে এশিয়া লাগোয়া কাজাখাস্তান, তুকমেনিস্তান, রুজবেকিস্তানের উপরেও প্রভাব বিস্তার করতে বদ্ধপরিকর রাশিয়া৷ এই হামলা চালিয়ে পুতিন এটা প্রমাণ করে দিতে চেয়েছেন যে প্রয়োজনে তাঁরা পেশিশক্তি প্রয়োগে পিছু পা হব না৷ 

আবার সমরনীতির সূত্র বলছে, যে কোনও পরিস্থিতিতে নিজেকে তৈরি রাখা৷ রাশিয়ার নৌবন্দরগুলি যখানে রুশ নৌবাহিনী রয়েছে সেগুলি শীতপ্রধান অঞ্চলে৷ ঠাণ্ডায় জস খানিকটা জমে যাওয়ায় জাহাজ চলাচলে অসুবিধা হয়৷ তাই দীর্ঘ দিন ধরেই রাশিয়া একটি উষ্ণ বন্দরের খোঁজে রয়েছে৷ যেখানে গোটা বছর জাহাজ চলাচল করতে পারবে৷ রাশিয়া, ইউক্রেনের কিছুটা নীচে উষ্ণ জলের বন্দর দখল করতে পারলে রুশ বাহিনীর মুভমেন্ট আরও ভালো হবে৷