তপন মল্লিক চৌধুরী: দু’চোখ ভরে কি আমরা শুধু আলোই দেখি? না, আলোর সঙ্গে অন্ধকার, ছায়া, আবছায়া… দেখি। কেবলই যদি আলোর মধ্যে আলো দেখি, তাহলে তো আর কিছু রেখে দেওয়ার থাকে না। তাই আলোকে অন্যভাবে দেখতে চাওয়ার ভাবনা থেকেই প্রথম ‘ক্যামেরা অবসকিউরা’, যেটা পিনহোল ক্যামেরার আদিরূপ।
ক্যামেরা অবসকিউরা একটা বন্ধ করা অন্ধকার ঘর। কিন্তু সে ঘরের মধ্যেও কোথা থেকে যেন আলো এসে দেওয়ালে, মেঝেতে আলোর প্রতিফলন তৈরি করে। আরব পণ্ডিত আবু আলি-আল-আসান ইবনে আল-আসান ইবনে আল হায়থাম-এর লেখা ‘কিতাব আল-মানাযির’ বা ‘বুক অব অপটিকস’–এ) আলোর এই প্রতিফলনের কথা বললেন। সে প্রায় ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের কথা। তিনি ‘আল বাইত আল মুথলিম’ শব্দটি তাঁর বইতে ব্যবহার করলেন। যার মানে ‘অন্ধকার ঘর’।
বিজ্ঞানীদের কাছে ক্যামেরা অবসকিউরা পরবর্তীতে সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে। একই সঙ্গে ছবি আঁকিয়েদের মধ্যেও দারুণভাবে চালু হয়ে যায়। তবে সেটা পরিচিতি লাভ করে ‘ক্যামেরা লুসিডা’ নামে। কারণ, ক্যামেরা লুসিডায় এমনভাবে প্রিজম লাগানো থাকে, যা আঁকিয়েদের আরও নিখুঁতভাবে ছবি আঁকতে সাহায্য করে।
এইভাবে ধাপে ধাপে ফোটোগ্রাফির ধারণা তৈরি হয়। আলো নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়। উনিশ শতকের গোঁড়ায় জোসেফ নিপসে নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে আলোকে সংরক্ষণ করতে পেরে গেলেন। যে ছবিটি প্রথম সংরক্ষিত ছবি হিসেবে পরিচিত, সেটি ছিল তাঁর ঘরের জানলা থেকে অন্য জানালার ছবি। টানা আট ঘণ্টার এক্সপোজার। ফলে সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য সেই ছবিতে নিপসের বাড়ির দু’পাশ দেখতে পাওয়া যায়।
একই সময়ে লুইস দ্যাগুয়েরোও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ছবি সংরক্ষণের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। পরবর্তীকালে এঁরা দু’জন একসঙ্গে পরীক্ষা চালান স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করতে। কিন্তু তেমনভাবে সফল হন না। ইতিমধ্যে নিপসে মারা গেলে দ্যাগুয়েরো একাই কাজ চালিয়ে যান। একদিন নিপসে আট ঘণ্টার এক্সপোজার ৩০ মিনিটে নিয়ে আসেন এবং একটি ছবিকে স্থায়ী করতে সফল হন।
এরপরে দ্যাগুয়েরো সেই ক্যামেরার নাম দেন ‘দ্যাগুয়েরোটাইপ ক্যামেরা’। পরবর্তীতে নিপসের ছেলে ও দ্যাগুয়েরো দ্যাগুয়েরোটাইপ ক্যামেরা ফ্রান্স সরকারের কাছে বিক্রি করে দেন। ফ্রান্স সরকার ফোটোগ্রাফির চর্চা সারা বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করে দেয়। সেই দিনটি ছিল ১৯৩৮ সালের ১৯ আগস্ট। এরপর থেকে দিনিটি বিশ্ব আলোকচিত্র দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
দ্যাগুয়েরোটাইপ ক্যামেরার ছবির একটা বড় সমস্যা ছিল যে একটা নেগেটিভ থেকে একটা ছবি প্রিন্ট করা যেত। যেটি ছিল ওয়েট প্লেট নেগেটিভ। উইলিয়াম হেনরি ফক্স ট্যালবর্ট গবেষণা শুরু করেন যাতে কাগজে ছবি তোলা যায়। তিনি আলো সংবেদনশীল কাগজ তৈরি করেন। তাঁর এই ক্যামেরার নাম দেন ‘ক্যালোটাইপ ক্যামেরা’। সেই ক্যামেরার পেপার নেগেটিভ থেকে অনেক ছবি প্রিন্ট করা যেত। কিন্তু সমস্যা হল ছবি বেশি স্পষ্ট নয়।
প্রসঙ্গত, ফোটোগ্রাফি চর্চা শুরু হওয়ার এক বছরের মধ্যেই এ দেশে আলোকচিত্রের চর্চা শুরু হয়। সেই সঙ্গে দ্যাগুয়েরোটাইপ ক্যামেরার ওপর কাজ হতে থাকে। ১৮৫০ সালে ওয়েট প্লেট নেগেটিভ থেকে ওয়েট প্লেট গ্লাস নেগেটিভ আবিষ্কৃত হয়, যার মাধ্যমে দ্যাগুয়েরোটাইপ ক্যামেরায় তোলা স্পষ্ট নেগেটিভ থেকে অনেকবার ছবি প্রিন্ট করা সক্ষম হয়। একে একে এডওয়ার্ড মুয়াইব্রিজ প্রমুখ নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে থেকেন। বিশ শতকের শুরুর দিকে ‘কোডাক ব্রাউনি’ ব্যবসায়িক উদ্যোগে ক্যামেরা বিক্রি শুরু করে। বড় বক্স ক্যামেরা থেকে ক্যামেরা তখন ছোট হয়ে দু’হাতের মধ্যে চলে আসে। ক্যামেরার আকার ছোট হওয়ার পাশাপাশি ফিল্মের আকারও ছোট হতে থাকে। আলোকচিত্রে স্ন্যাপশটের যাত্রা শুরু হয়।
আস্তে আস্তে ক্যামেরার আকৃতি পরিবর্তন হয়। বক্স ক্যামেরা থেকে এসএলআর ক্যামেরা হয়। অ্যানালগ ফিল্ম থেকে ডিজিটাল সেন্সর যুক্ত হয় ক্যামেরায়। আবার সেই সেন্সর ছোট হতে হতে সংযোজিত হয় মুঠোফোনে।