কলকাতা: মাধ্যাকর্ষণ বা অভিকর্ষ বলের কথা উঠলেই মনে আসে স্যার আইজাক নিউটনের তত্ব৷ গাছ থেকে মাটিতে আপেল খসে পড়ার কারণ খুঁজতে খুঁজতেই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন অভিকর্ষের তত্ব৷ তবে পৃথিবীর সর্বত্র মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সমান নয়৷ সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের মাঝে খোঁজ পেয়েছেন এক সুবিশাল গর্তের৷ যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অত্যন্ত দুর্বল৷ তবে কি ওই গর্ত ধরেই পৌঁছে যাওয়া যাবে পৃথিবীর কেন্দ্রে? নাকি এই গর্তে লুকিয়ে রয়েছে মায়াভরা পৃথিবীর অন্য কোনও রহস্য৷ ভারত মহাসাগরের অতলে লুকিয়ে থাকা সেই গর্তকে কেন্দ্র করে চড়ছে কৌতুহলের পারদ৷
সম্প্রতি ভারত মহাসাগরের মাঝামাঝি এলাকায় একটি বিশালাকার গর্তের খোঁজ মিলেছে৷ সমুদ্র বিজ্ঞানীদের দাবি, গর্তটির নীচের অংশের ভর পৃথিবীর অন্য যেকোনও জায়গার তুলনায় অনেকটাই কম। সেই সূত্রেই সমুদ্রতলের এই অঞ্চলের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব হ্রাস পেয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের অনুমান৷
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে আজও বিজ্ঞানীদের চর্চার বিষয়। বহু বছর ধরেই এর উৎপত্তি ও উৎসস্থল নিয়ে গবেষণা চলছে। ভারত মহাসাগরের গভীরে ওই বিরাট গর্তের খোঁজ মিলতেই নতুন করে শুরু হয়েছে চর্চা। গর্তটির গভীরে পৌঁছনো গেলে মাধ্য়াকর্ষণ নিয়ে এতদিনের ধারণায় অনেক বদল আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে৷
ওই দৈত্যাকার গহ্বরটির অবস্থান শ্রীলঙ্কার ঠিক দক্ষিণে৷ বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এর নাম ইন্ডিয়ান ওশান জিওয়েড লো (IOGL)৷ একে ‘গ্র্যাভিটি হোল’ বা অভিকর্ষীয় গহ্বরও বলা হয়। এর আয়তন ৩০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি। এটি কিন্তু একেবারে নিখুঁত গোলকাকৃতি নয়। ভারত মহাসাগরের যে জায়গায় গহ্বরটি রয়েছে, গোটা বিশ্বের নিরিখে সেখানে সমুদ্রের জলস্তর ১০০ মিটারেরও নীচে। কারণ সেখানে পৃথিবীর অভিকর্ষ বল অত্যন্ত দুর্বল।
উল্লেখ্য়,কয়েক বছর আগে পৃথিবীর কেন্দ্রভাগ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিল বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স। এই সংস্থার সেন্টার ফর আর্থ সায়েন্সেস বিভাগে চলছে গবেষণা মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে গবেষণার কাজ। উল্লেখ্য বিষয় হল, বিজ্ঞানীদের একটি টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন দুই বাঙালি ভূতাত্ত্বিক দেবাঞ্জন পাল ও আত্রেয়ী ঘোষ। ভারত মহাসাগরের গভীরে সুবিশাল গর্ত আবিষ্কার নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁরা।
ভারত মহাসাগরে ওই গর্ত সৃষ্টির সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে দুই ভারতীয় গবেষক দেবাঞ্জন ও আত্রেয়ী জানান, প্রাচীন সমুদ্রের তলে ওই গর্তের উৎপত্তি। টেকটোনিক যুগে দু’টি প্লেটের সংঘর্ষের ফলে সমুদ্র গর্ভের ওই জায়গা ডুবে গিয়েছিল। প্রায় ১৪০ মিলিয়ন বছর আগে ধীরে ধীরে সরতে থাকে টেকটোনিক প্লেট। এর ফলে নতুন করে পৃথিবীর কেন্দ্র বা ম্যান্টেল অংশ গড়ে উঠতে থাকে। ওই সময় আফ্রিকার গভীর থেকে উঠে আসা গলিত শিলার কারণে সমুদ্রের বুকে গর্তটি তৈরি হয়। এমনটাই দাবি করেছেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের ভূবিজ্ঞানী দেবাঞ্জন এবং আত্রেয়ী।
তাঁদের কথায়, “আমাদের পৃথিবী কিন্তু নিখুঁত গোলক নয়। যেমন আমরা বইতে পড়েছি৷ যদি এটা পুরোপুরি গোলাকার হোত, তাহলে মাধ্যাকর্ষণ ভূপৃষ্ঠের প্রতিটা বিন্দুতে সমান হোত। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা নয়। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণের দুই মেরু এলাকাই একটু চ্যাপ্টা। আর পেটের বিষুব রেখার জায়গাটি কিছুটা বাইরের দিকে বেরিয়ে এসেছে।’’ তবে ওই গর্তের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ কেন অনেকটা কম, সে প্রসঙ্গে তাঁদের বক্তব্য, বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখতে হবে। এই নিয়ে গবেষণা চলছে বলেও জানিয়েছেন দেবাঞ্জন ও আত্রেয়ী।
ভারত মহাসাগরের বুকে মুখ লুকিয়ে থাকা ওই গহ্বরটি ১৯৪৮ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। আবিষ্কার করেন ওলন্দাজ ভূ-বিজ্ঞানী ফিলিক্স ভেনিং মিনেজ। তার পর কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে এর অবস্থান এবং আয়তন নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ওই গহ্বরের সৃষ্টির কারণ নিয়ে ধন্দ ছিল।