সংসার-সন্তান পিছুটান, ‘লিঙ্গ সমতা’র মাপকাঠি নির্ধারনে মানবিকতার মূল্যায়ন ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক

প্যারেন্ট রিসোর্স অ্যাপ্লিকেশন উইনি এবং অনলাইন ট্যালেন্ট মার্কেটপ্লেস 'দ্য মম প্রজেক্ট'এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৮১ শতাংশ মহিলা বলেছেন যে শিশুসন্তানদের যত্ন নেওয়ার মত বিষয়গুলি তাদের কর্মক্ষেত্রে যুক্ত থাকার  সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

সুনন্দা বারুই: আন্তর্জাতিক নারী দিবসে  ২০২০-র মূল ভাবনা হলো “আই অ্যাম জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি: রিয়্যালাইজিং ওমেন'স রাইট”। কিন্তু এযুগের সামাজিক প্রেক্ষাপটেও লিঙ্গসমতায় নজিরবিহীন ভাবে বৈষম্য তৈরী হচ্ছে নানান ক্ষেত্রে। আত্মনির্ভরশীল কর্মরত মহিলাদের সমস্যা আরও বেশি। একদিকে সম কাজে সম বেতন বা সুযোগ সুবিধা থেকে নারীদের বঞ্চিত করে তেমন বৈষম্য তৈরী করা হচ্ছে, তেমনই বৈষম্য তৈরী হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের সময় এবং খরচের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, সংসার, সন্তান সামলে কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের দূরত্ব এবং সেই অনুপাতে প্রয়জনীয় সময় ও খরচ। এক্ষেত্রে গোটা বিশ্বে আজও বেশিরভাগ মহিলারাই কম দূরত্বের মধ্যেই কাজের জায়গা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এর একটি বড় কারণ হ'ল পুরুষদের চেয়ে নারীরা সংসার বিশেষত সন্তানের পরিচর্যায় বেশী সময় দিয়ে থাকে বা সময় দিতে বাধ্য থাকে। পাশাপাশি তাদের সাশ্রয়ী মনোভাব। ওইসিডি ফ্যামিলি ডেটাবেস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে উঠে এসেছে এমনই পরিসংখ্যান। যেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রতিদিনের যাত্রাপথে ব্যয় করা গড় সময় ছোটো বাচ্চাদের (স্কুলে ভর্তি হয়নি এমন বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে) অভিভাবকদের মধ্যে পুরুষদের তুলনায়  মহিলাদের জন্য অনেকটাই কম।

তাই কাজের ক্ষেত্রে আয়ের পার্থক্যের সঙ্গে এই পার্থকগুলিও যুক্ত হয়েছে। অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স (এনওএস)-এর সমীক্ষাতেও দেখা গেছে কর্মক্ষেত্রের দূরত্ব যত বেশি, উপার্জনও ততটাই বেশি। কিন্তু বিবাহিত বা বিবাহিত হলেও যতদিন পর্যন্ত সন্তানের জন্ম না হচ্ছে সেই মহিলারাই বাইরে কাজের ক্ষেত্রে বেশি সময় দিতে পারেন এবং নিশ্চিন্তে বেশী দূরত্বের কর্মক্ষেত্র বেছে নিতে পারেন। ফলে তাঁদের উপার্জনের পরিমানও  বেশি হয়। কিন্তু একটি সন্তানের জন্ম মানেই সেই সময়ের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানের যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব যেহেতু মায়েদের ওপরেই বেশিরভাগটা এসে পড়ে। সেহেতু মহিলারা বাড়ির কাছাকাছি কাজের জায়গা খুঁজে নিতে বাধ্য হন। ফলতঃ নিজের দক্ষতা অনুসারে জীবিকা বা উচ্চ-বেতনের জীবিকার সম্ভাবনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কমে যায়। সংসার, সন্তান আর কর্মক্ষেত্রের দায়িত্ব একইসঙ্গে সমানভাবে পালন করা দুরূহ হয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশেও এই সমস্যার সম্মুখীন সেখানকার কর্মরত মহিলারা।

ভারতের মত দেশে তো এই সমস্যা আরও মারাত্মক। যেখানে বাড়ির বাইরে কাজ করার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সময় নয় আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে  কম খরচে যাতায়াতের মাধ্যম, এই দুইয়ের কথাই মাথায় রাখতে হয় কর্মরত মহিলাদের। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ির কাছাকাছি কর্মসংস্থানের একটা সীমাবদ্ধতা তৈরী হয়। সাধারণভাবে কোনো পুরুষ ও মহিলার অফিসে যাতায়াতের জন্য যদি ১ঘন্টা সময় লাগে সেক্ষেত্রে সময় বাঁচাতে গিয়ে সর্বোচ্চ ১০মিনিটের যাত্রাপথে সীমাবদ্ধ কর্মক্ষেত্রগুলিতেই মহিলাদের যোগ দেওয়ার প্রবনতা বেশি। 

প্যারেন্ট রিসোর্স অ্যাপ্লিকেশন উইনি এবং অনলাইন ট্যালেন্ট মার্কেটপ্লেস 'দ্য মম প্রজেক্ট'এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৮১ শতাংশ মহিলা বলেছেন যে শিশুসন্তানদের যত্ন নেওয়ার মত বিষয়গুলি তাদের কর্মক্ষেত্রে যুক্ত থাকার  সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। বিশেষত, শিশুসন্তানের পরিচর্যায ও সংসারের নিত্যদিনের কাজকর্মে পর্যাপ্ত সময় দিতে মহিলাদের বাড়িতে থাকার ইচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে সময় দেওয়ার থেকেও বেশি প্রাধান্য পায়। তাই পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুসন্তানদের বড় করে তুলতে    মহিলাদের উপার্জনের সম্ভাবনার ২০শতাংশ হাতছাড়া হয়ে যায় । অর্থাৎ সন্তানকে সময় দিতে গিয়ে একটা বড় অংশের মহিলা চাকুরিজীবীরা চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে থাকতে বাধ্য হয়।

সুতরাং নারী স্বাধীনতা, পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকারের প্রশ্নে আজও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়ছেন নারীরা। শুধুমাত্র সমাজ ও পরিবারের সাহযোগিতা ও সহমর্মিতার অভাবে। যেখানে নারীদের দশভুজার সঙ্গে তুলনা করে ঘরে বাইরে সমান পারদর্শী বলে বর্ণনা করা হলেও এর জন্য তাঁকে কতটা মূল্য দিতে হচ্ছে তার হিসেব হয়তো নারীরা নিজেরাও রাখেন না। শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা এরপর মাথা উঁচু করে বাঁচতে গিয়ে কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদে আসীন হয়েও সংসার আর সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধ (যা কিনা একজন পুরুষের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য) নারীর সেই সমস্ত স্বপ্ন মূহুর্তে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। অথচ এই সংসার আর সন্তানের সমান ভাগীদার পুরুষ সমাজ কথিত দুর্বল নারী সমাজের কাঁধেই সমস্ত দায়িত্বভার তুলে দিয়ে  নিশ্চিতে, নির্দ্বিধায় মানুষ হিসেবে জীবনের স্বাধীনতার সমস্তটাই একা ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছে। সুতরাং এখানে লিঙ্গ সমতার থেকেও বড় প্রশ্ন ওঠে মানবিকতাবোধ নিয়ে। একমাত্র মানবিকতার প্রকৃত মর্মাথ বাস্তবিক অর্থে প্রয়োগ হলেই প্রকৃত অর্থে সমস্ত বৈষম্য কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *