করোনার নেপথ্যে বড় হাত বাদুড়ের এই প্রজাতির! বলছে গবেষণা

করোনার নেপথ্যে বড় হাত বাদুড়ের এই প্রজাতির! বলছে গবেষণা

ওয়াশিংটন: এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে একটাই গবেষণা চলছে কীভাবে নোভেল করোনা প্রতিরোধে করা যায় এবং করোনা আক্রান্তদের সুস্থ করে তোলা যায়। তবে কিছু গবেষকরা এরই মধ্যে এই নতুন ভাইরাসকে কেন্দ্র করেই শুরু করে দিয়েছেন ভবিষ্যতে এমন মহামারীর উৎসের খোঁজ। অর্থাৎ সেই উৎস এবং মাধ্যম প্রাণীগুলির যাদের দেহ থেকে সেই মারণ ভাইরাস গুলি মানুষের শরীরে ঢুকে পড়তে পারে এবং খুব সহজেই নিজের বিবর্তন ঘটিয়ে দ্রুত সংক্রমণ ছড়াতে পারে।

করোনা ভাইরাসগুলির এক্ষেত্রে অত্যন্ত বদনাম রয়েছে তাদের বিশৃঙ্খল স্বভাবের জন্য। এই ভাইরাস এমনই যা নতুন প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে সহজেই পরিবর্তিত হয়ে সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে নিয়ে পারে। এই করোনা ভাইরাসের অন্তত ১৩০টি প্রজাতি নিজেদের শরীরের বহন করে বেড়ায়। আর নোভেল করোনা ভাইরাসের নেপথ্যে  রয়েছে চীনের বিশেষ এক প্রজাতির বাদুড় 'হর্সসশু ব্যাট'।
এপর্যন্ত গবেষণায় দেখা গেছে, এই বাদুড়ের দেহ থেকেই সার্স কোভ-২ ভাইরাসটি সম্ভবত মধ্যস্থতাকারী কোনো প্রাণীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল (যা এখনও গবেষকদের কাছে অজানা) এবং পরে মানবদেহে সংক্রমণ ঘটায়।

এই হর্সশু বাদুড়ের ১০০টি স্বীকৃত প্রজাতি আছে। অদ্ভুত দর্শন এই বাদুড়দের নাকের অংশ বিশেষ অশ্বখুড়াকৃতির। তাই এদের এমন নামকরণ করা হয়েছে। এদের একশোটি প্রজাতির মধ্যে রাইনোলোফাস অ্যাফিনিস প্রজাতির র্যাটিজি ১৩ হ'ল হল এদের মধ্যে নির্দিষ্ট সেই হর্সশু ব্যাটের নাম, র্যাঙ্ক এবং ক্রমিক সংখ্যা। গবেষণার জন্য ২০১৩ সালেই চীনের ইউনান শহরে বাদুড়ের একটি গুহা থেকে এই প্রজাতির বাদুড়ের মলের নমুনা সংগ্রহ উহানের ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজির হ্যাজমাট-পরিহিত বিজ্ঞানীরা যা এবছর জানুয়ারী পর্যন্ত ল্যাবেই রাখা ছিল এবং বিজ্ঞানীরা সেটা ভুলেই গেছিলেন। আর এই নমুনার মধ্যেই ছিলো কোভিড-১৯ ভাইরাসটি। আসলে তখন ২০০২-০৩ সালের সার্স মহামারীর উৎস খুঁজতে ব্যাস্ত ছিলেন উহান গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা। আর এই হর্সশু বাদুড়ের আর একটি প্রজাতি অপেক্ষাকৃত ছোটো ডানাযুক্ত রাইনোলোপাস সিনিকাসের মধ্যেই সার্স রোগের ভাইরাসের সফল খোঁজ মেলে। আর সমস্যার সূত্রপাত সম্ভবত সেখান থেকেই যেখানে এই ভাইরাসের মারাত্মক প্রভাব রয়েছে জানা সত্ত্বেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

ইউনানের রাজধানী কুনমিংয়ের দক্ষিণে শিতো গুহায় তারা বাদুড়ের উচ্ছিষ্ট এবং লালারসের মধ্যে এমন ভাইরাস খুঁজে পেয়েছিলেন, যার সঙ্গে খেজুর গাছের গন্ধগোকুল বা খট্টাসের মধ্যে পাওয়া ভাইরাসগুলির থেকেও মানুষর দেহে পাওয়া সার্স ভাইরাসের সঙ্গে অনেক বেশি মিল ছিল। এই  ছোট স্তন্যপায়ীটিকে তখনও পর্যন্ত মানুষের মধ্যে সংক্রমণের উৎস বলে মনে করা হয়নি। কিন্তু পরীক্ষাগারে ফিরে তারা লক্ষ্য করল যে ওই বাদুড়ের উচ্ছিষ্ট থেকে পাওয়া ডাব্লু১ভি১ ভাইরাসগুলি, বানর এবং মানব কোষগুলিতে বিশেষভাবে যুক্ত হয়ে বিস্তার লাভ করতে সক্ষম বিশেষত এসিই-২ রিসেপ্টরগুলির সঙ্গে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে নিজের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। যার ফলে কোনও করোনভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিন এর চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে। তখন থেকেই এটি নিশ্চিত করা হয় যে সারসের ভাইরাস বাদুড় থেকে সরাসরি মানুষের দেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

এরপর ২০১৬-তে চ্যাপেল হিলের নর্থ ক্যলোরিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাফেল ড্রিংকের নেতৃত্বে গবেষকদল গবেষণা করে জানতে পারে একই ভাইরাস ইঁদুরের দেহেও সংক্রমণ ঘটাতে পারে। যখন কোভিড-১৯ মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন প্যঙ্গোলিনকেই প্রাথমিকভাবে এর জন্য দায়ী করা হয়। এরপর গবেষনায় দেখা যায় যে এই প্যাঙ্গোলিনের দেহে র্যাটিজি-১৩ হর্সশু বাদুড়ের দেহেও আছে।

একই ধরণের আরও একটি গবেষণায় দেখা যায় যে মানুষের ভাইরাস এবং আরটিজি-১৩ ভাইরাসের এই পূর্বপুরুষ কমপক্ষে ৪০ বছর আগেও বেঁচে ছিলো। সুতরাং ইউনানের গুহায় (উহান থেকে এক হাজার মাইল) যে গুহাটি সেখানে প্রথম সংক্রমণ ঘটেছিল বা হর্সশু বাদুড় সেই গুহা থেকে উহানের কাছাকাছি কোথাও খাওয়ার জন্য বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আনা হয়েছিল। যদিও এখনও বিষয়টি পরিষ্কার নয় যে বিশেষত হর্সশু বাদুড় কেন করোনভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়। মূলত  সাধারণ বাদুড়ের তুলনায় এগুলি আকারে অনেক বেশি বড়। এরা সাধারণত পৃথিবীর প্রাচীন উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করে। তবে কিছু উষ্ণ অঞ্চলেও তাৎপর্যপূর্ণভাবে এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও একটি গুহায় একসঙ্গে বহুসংখ্যক হর্সশু বাদুড়ের বাস।

হাউস অফ লর্ডসের সদস্য এবং লেখক রিডলের লেখা ' হাউ ইনোভেশন অফ ওয়ার্কস' বইতে উল্লেখ করা হয়েছিল, ইবোলা, হেন্দ্র, নিপা, মারস এবং সার্সের সংক্রমণের সময় থেকেই বিজ্ঞানীর ভয়ঙ্কর ভাবে সতর্ক করেছিলেন বাদুড় থেকে সংক্রমণ ছড়ায় এমন ভাইরাসগুলি থেকে। ২০১৩ সালে ইউনান বাদুড়ের গুহা আবিষ্কারটি একটি ভয়াববহ সতর্কতা ছিল। এই মহামারীটি শেষ হয়ে গেলেও অন্য আরো মহামারীর সম্ভবনার আভাস দেওয়া হয়েছিল তখন থেকেই। বাদুড় ৩০ বছর অবধি বেঁচে থাকে এবং করোনাভাইরাস থেকে তাদের মধ্যে তাদের মধ্যে কোনো ক্ষতিকর সংক্রমণ দেখা যায় না। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তা মহামারীর আকার নিতে পারে। তাই তখন থেকেই সতর্কতা ছিল যে র্যাটিজি-১৩ (হর্সশু বাদুড়ের এক বিশেষ প্রজাতি) এখনও বেঁচে থাকতে পারে। যদিও বুধবার চিনের এক গবেষণাকে উদ্ধৃত করে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ জানিয়েছে, বাদুড়ের থেকে মানবদেহে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়েছে, এই ঘটনা বিরল৷ হাজার বছরে এরকম একবার ঘটতে পারে৷

তথ্যসূত্র- (ন্যশনাল জিওগ্রাফিক,দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল,ন্যশনাল রিভিউ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 − 6 =