পুরুষের চেয়ে দিনে ৫০ মিনিট বেশি কাজ করেন মহিলারা! প্রশ্নের মুখে নারীর সমান অধিকার

উন্নত দেশে একজন মহিলা প্রতিদিন পুরুষের চেয়ে ৩০ মিনিট বেশি কাজ করেন। আর উন্নয়নশীল দেশে কাজ করেন ৫০ মিনিট বেশি। মহিলারা তাদের অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি হিসেবে অর্থাৎ গৃহীনি পদে পুরুষদের তুলনায় গড়ে তিনগুণ বেতনের সমপরিমাণ কাজ করেন।

সুনন্দা বারুই: নারী আজ স্বাধীন, আত্মনির্ভর, সর্বক্ষেত্রে সম্মানীয় পদে নিযুক্ত এবং সর্বোপরি সামাজিক বাধা কাটিয়ে উঠে আত্মসম্মানের সঙ্গে নিজেদের দাবি ও অধিকার নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে চলার মত অবস্থানে পৌঁছেছে। 

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো ২০২০-র 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস'-এর মূল ভাবনা  “ আই অ্যাম জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি: রিয়্যালাইজিং ওমেন'স রাইট”। অর্থাৎ এই তৃতীয় বিশ্বের যুগেও নারীর সমান অধিকারে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন? আসলে নারী পুরুষ নির্বিশেষে বিশ্বসমাজ বাহ্যিক দাসত্ব কাটিয়ে উঠলেও মানসিক দাসত্ব কাটিয়ে উঠতে পারেনি আজও। “সমান বিশ্ব, সক্ষম বিশ্ব” এবং “স্বতন্ত্রভাবে, চিরদিন, প্রতিদিন আমরা আমাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা এবং কর্মপ্রক্রিয়ার জন্য দায়বদ্ধ। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে না পারলে নারীর সমান অধিকারের সঙ্গে এই প্রশ্ন চিহ্ন থেকেই যাবে। 

নারীর অসমতার প্রশ্নে বিগত দুদশক পুরোনো ধ্যাণধারণাগুলি কমবেশি সবক্ষেত্রেই আজও বর্তমান। তবে নারী প্রগতির মে অন্যতম হাতিয়ার অর্থাৎ শ্রমের বিনিময়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা। সেক্ষেত্রে বিভাজন বেড়েই চলেছে।  এই দুদশকে নারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়লেও তার কোনো প্রতিফলন নেই কর্মক্ষেত্রে। সব থেকে লজ্জাজনক বিষয় হল, বিশ্বের কোনও দেশ এক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা অর্জন করতে পারেনি।

শ্রমের বাজারে মজুরি কমিয়ে রাখার জন্য সেই মার্কসের ধ্রুপদি তত্ত্ব আজও তাই প্রাসঙ্গিক। 'সস্তা শ্রমের জোগানদার হিসেবে ব্যবহৃত হয় মেয়েরাই'। 

নারীমুক্তি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস: 

অতীতে ফিরে তাকালে ১৮৬৪ সালে শ্রমিক শ্রেণির প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলার সময় থেকেই কার্ল মার্ক্স কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকারের প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন। যদিও সেই সময় নারীদের কল্যানে তাঁর এই উদ্যোগ বহু সমালোচনা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অনড়। প্রথম আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়নগুলোতে পুরুষের সঙ্গে নারী শ্রমিকদেরও সভ্য করা হয় এবং তাদের সমান অধিকারের দাবি ঘোষণা করা হয়।  এরপর থেকেই ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি প্রভৃতি দেশে নারী শ্রমিকেরা সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে।

এরপর ১৮৬৬ সালে জন স্টুয়ার্ট মিল, ইংরেজ দার্শনিক অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিক (১৮০৬-১৮৭৩) নারীর সমান অধিকারের দাবি জানিয়ে পার্লামেন্টে একটি আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলেন। এই আবেদনপত্রে দেড় হাজার নারী-পুরুষ স্বাক্ষর করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, বাটলার, হ্যারিয়েট মানিডু, মারি সমার ভিল প্রমুখ।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে একদল অভিজাত শ্রেণির নারী ক্রীতদাসপ্রথার বিরুদ্ধে ও নারীমুক্তির আন্দোলনে শামিল হন। দুই বোন সারা ও অ্যাঞ্জেলিনা গ্রিম ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আরও এক সক্রিয় নেত্রী লুক্রোশিয়া মট সেনেকা ফলস। তাঁরা উইমেন রাইটস কনভেনশন  সংগঠিত করেছিলেন। সেনেকা ফলসের কনভেনশনে নারীর অধিকারের জন্য মোট বারোটি প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল সম্পত্তির অধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, ব্যবসা-বাণিজ্যে নারীদের অধিকার সহ বেশ কয়েকটি অধিকার। এরমধ্যেই ছিল প্রস্তাবটি ছিল নারীদের ভোটাধিকার। সেসময় এই অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল নারী সমাজ।

এই ধারা বহন করেই প্যারি বিপ্লবের সময় শ্রমজীবী নারীরা এক সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেন যা ঐতিহাসিক এবং অবিস্মরণীয়। সে সময় প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে এগিয়ে এসেছিলেন সর্বস্তরের শ্রমজীবী নারীরা এমনকি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী নারীরাও।

১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্টে প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের মূল কথা ছিল নারী-পুরুষের সমানাধিকার। ক্লারা জেটকিন এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে নির্বাচিত হন।

১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের বস্ত্রশিল্পে নারী শ্রমিকদের ঐতিহাসিক ভোটাধিকার আন্দোলন শুরু হয়। ১৯০৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কেই শ্রমিক মহিলাদের একটি সভায় নারীর ভোটাধিকার দাবি করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এখান থেকেই  প্রতি বৎসর ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন ক্লারা জেটকিন।

এরপর ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হতে শুরু হয়।

১৯১৪ সালে বেশ কয়েকটি দেশ ৮মার্চ দিনটিকে নারী দিবস হিসেবে পালন করতে শুরু করে। 

অবশেষে, ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়ে নারী দিবস পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। 

১৯১৫ সালে জাতিপুঞ্জের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, শ্রমজীবী অংশের মধ্যে পুরুষ ও নারীর প্রভেদ দূর করতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতি:

 রাজনীতিক,বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন, শিল্পী বা নভোচারী – ভবিষ্যতে আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য নারীদের এইধরণের স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা আজও বর্তমান। বরং ‘নারীর পূর্ণতা মাতৃত্বে’। এই দাবিই এখনও পর্যন্ত জোরালো। আর এই পূরণ করতে গিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পূর্ণ শ্রমিক থেকে ক্রমশ আংশিক শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে মেয়েরা। আমাদের দেশে নারীশিক্ষার প্রসার, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ ইত্যাদি বিষয়ে সেই উনিশ শতক থেকে সমাজের প্রগতিশীল অংশ উদ্যোগী হয়েছিলেন। আশ্চর্য ও লজ্জাজনক বিষয় হলো আজও এই লক্ষ্যে সমাজ সংস্কারের কাজ চলছে।

কাজের ক্ষেত্রে ঘরে-বাইরে সমানভাবে হেনস্থার শিকার নারী। রাস্তা ঘাটে, অফিসে যৌন হেনস্থার পাশাপাশি ঘরোয়া জীবনেও নিরাপত্তার অভাব। নিরাপত্তার অভাবজনিত মৃত্যুর মধ্যে ৮ থেকে ১১ শতাংশ যেখানে গর্ভপাত-সংক্রান্ত। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আত্মহত্যা বলে উল্লিখিত অর্ধেকেরও বেশি (৫৮ শতাংশ) মহিলার মৃত্যু হয়েছে পরিবারের সদস্যদের হাতে। অর্থাৎ আত্মহত্যা নয় তাদের হত্যা করা হয়েছিল –  প্রতিদিনের হিসেবে এই সংখ্যা ১৩৭ জন। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নির্ভরতাই প্রধান কারণ।

অথচ সমীক্ষা বলছে, কর্মক্ষেত্রে ঘন্টার হিসেবে নারীপুরুষের জন্য বরাদ্দ  সমান হলেও মেয়েদের ঘরের কাজ কখনোই সেই হিসেবের মধ্যে ধরা হয়না। যদি তা ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে উন্নত দেশে একজন মহিলা প্রতিদিন পুরুষের চেয়ে ৩০ মিনিট বেশি কাজ করেন। আর উন্নয়নশীল দেশে কাজ করেন ৫০ মিনিট বেশি। মহিলারা তাদের অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি হিসেবে অর্থাৎ গৃহীনি পদে পুরুষদের তুলনায় গড়ে তিনগুণ বেতনের সমপরিমাণ কাজ করেন।

প্রতিবছর বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের তালিকার শীর্ষে ক্ষমতাশালী শতাধিক নারীর নাম উঠে আসে। রাজনীতি, ব্যবসা, সমাজ উন্নয়ন, শিক্ষা, চিকিৎসা-সব ক্ষেত্রেই নারীরা নিজের ক্ষমতার নজির গড়েছে। 

তাই সত্ত্বেও বিগত তিন বছরে নারী দিবসের থিম সবাইকে মনে করিয়ে দেয়, লিঙ্গবৈষম্য মুক্ত বিশ্ব তৈরির নৈতিক দায়িত্ব সকলের। ২০১৯ সালের থিম ছিল ‘ব্যালান্স ফর বেটার’, অর্থাৎ লিঙ্গ-ভারসাম্য বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় সমতার গুরুত্ব অনিবার্য। ২০১৮ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘প্রেস ফর প্রগেস’। ২০১৭ সালের থিম ছিল ‘বি বোল্ড ফর চেঞ্জ’। আর এবছর ২০২০ সালের থিম ‘জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি’ বা হ্যাশট্যাগ ‘ইচ ফর ইক্যুয়াল’।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপের প্রতিবেদন বলছে, লিঙ্গসমতা আগামী ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যমান থাকবে। তাই বিশ্বজুড়ে নারী দিবস প্রচার-প্রচারণায় ‘কল-টু-অ্যাকশন’এ গুরুত্ব দিয়ে নারী পুরুষ ভেদাভেদের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে নারীর প্রাপ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠাই হোক অঙ্গীকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 − two =