তপন মল্লিক চৌধুরী: মঙ্গলবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর দেশ করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করে ফেলেছে। পুটিনের ঘোষণার পরই সেই দাবিকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কানাডা তো পুটিনের দাবিকে পুরোপুরি খারিজ করে দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনও পায়নি সেই ভ্যাকসিন।
বিশেষঙ্গরা বলছেন, রশিয়া এই ভ্যাকসিন নিয়ে কোনো ক্লিনিকাল ট্রায়াল রিপোর্ট দেয়নি। সাধারণত, তৃতীয় পর্যায়ে কয়েক লাখ লোককে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। তার ফলাফল সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পরই ভ্যাকসিনকে ছাড়পত্র দেয়া হয়।
রাশিয়ার দাবি, তারা হাজার কয়েক লোকের ওপর এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষা করেছে। মস্কোর অ্যাসোসিয়েশন অফ ক্লিনিকাল ট্রায়ালস অর্গানাইজেশন চলতি সপ্তাহেই স্বাস্থ্যমন্ত্রককে অনুরোধ করেছিল, এই ভ্যাকসিন নিয়ে তাড়াহুড়ো না করতে। কিন্তু তারা সে কথা কানে তোলে নি।অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ভ্যাকসিন অনুমোদন দেওয়ার আগে সুরক্ষা বিষয়ক যাবতীয় তথ্য খুব ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। তারমানে রাশিয়ার করোনা ভ্যাকসিন বিস্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছাড়পত্র পায় নি। ছাড়পত্র দেওয়ার আগে সুরক্ষা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্যের বিচার করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
রাশিয়া করোনা ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক-৫’ ব্যবহারের জন্য যে অনুমোদন দিয়েছে তা মানবদেহে প্রয়োগের দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যেই। যে কারণে প্রশ্ন তুলেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, ট্রায়ালের সম্পূর্ণ তথ্য ছাড়া ভ্যাকসিনটির সুরক্ষা ও কার্যকারিতার বিশ্বাস করা জায় না। তাহলে কি রাশিয়ার করোনা ভ্যাকসিন আবিস্কারে প্রথম হওয়ার জন্য এমন তাড়াহুড়ো করল? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দৌড়ে আছে ১৭০ টির বেশি উদ্যোগ। সাধারণত একেকটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষা-পর্ব মিটিতেই কয়েক বছর লেগে যায়। তবে কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন সেটাকে ১২ থেকে ১৮ মাসে নামিয়ে আনার।
রাশিয়া এত তাড়াতাড়ি করোনার ভ্যাকসিন বের করে ফেলায় রীতিমতো সন্দিগ্ধ বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, ভ্যাকসিন নিয়ে দীর্ঘদিন ট্রায়াল দিতে হয়। তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখতে হয়। বিভিন্ন ধরনের মানুষের ওপর তা প্রয়োগ করতে হয়। রাশিয়ার ভ্যাকসিন এই পর্বগুলি পার করে নি। বিশেষঙ্গরা বলছেন, ভ্যাকসিনের সুরক্ষার দিকটা খুব জররি। সে দিক থেকে রাশিয়ার ভ্যাকসিন নিরাপদ নাও হতে পারে। মানবদেহে ভ্যাকসিন নিয়ে দীর্ঘ পরীক্ষা দরকার। তা না করে বাজারে ছাড়া হলে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ হবে।
বোঝা যাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশ রাশিয়ার ভ্যাকসিনের সুরক্ষার দিকটা নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত। নির্দিষ্ট সংখ্যক লোকের ওপর পরীক্ষা এবং তার ফলাফল বিশ্লেষণ করতেও সময় লাগে। রাশিয়া তাদের ভ্যাকসিন নিয়ে কবে সেইসব পরীক্ষা নিরীক্ষা করল? শুধু তাই নয়, মস্কোর গামালেয়া ইনস্টিটিউটের তৈরি ভ্যাকসিনটির বৈজ্ঞানিক রিপোর্টও কোনো বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করা হয়নি।
করোনার সম্ভাব্য একটি ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের সঙ্গে যুক্ত জার্মানির ইউনিভার্সিটি হসপিটালের বিশেষজ্ঞ পিটার ক্রেমসনার মস্কোর তৈরি ভ্যাকসিন সম্পর্কে বলেন, তড়িঘড়ি করে রাশিয়ার ভ্যাকসিন ব্যবহারের এ ধরণের অনুমোদন বেপরোয়া সিদ্ধান্ত।
শুধু বিজ্ঞানী আর বিশেষজ্ঞ নয় স্বাস্থ্য বিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা ডব্লিউএইচও রাশিয়ার তৈরি ও অনুমোদন পাওয়া ভ্যাকসিন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেছে, তারা যে ভ্যাকসিন মানুষের ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওই ভ্যাকসিন নিয়ে মূল্যায়ন করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য পায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীভাবে তৈরি হলো, সুরক্ষা সম্পর্কিত তথ্য, রোগ প্রতিরোধে কতটা সক্ষম ছাড়াও আদৌ এই ভ্যাকসিন কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ ঠেকাতে পারে কিনা— এসব বিষয় নিয়ে রাশিয়া বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ না করায়, বিজ্ঞানী, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ মানুষ ধোঁয়াশার মধ্যে পড়েছেন।