বেজিং: বিশ্বের ত্রাস করোনা এপর্যন্ত প্রাণ কেড়েছে ১৬০,৮৯৬ জনের। সংক্রমণ ছড়িয়েছে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই। এখনও পর্যন্ত এই রোগের নির্দিষ্ট ওষুধ বা ভ্যাকসিন নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা মিলছেনা কোনো দিশা। আর এই আতঙ্কের পরিস্থিতিতে ঘুরে ফিরে একটাই প্রশ্ন উঠছে মানুষের মনে, তা হল এই ভাইরাসের উৎপত্তি কোথায়?
বাদুড়ের দেহে এই ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হলেও এমনকি এই ভাইরাস প্রাণীবাহিত বলে বিশেষজ্ঞরা বার বার দাবি করলেও। সার্স কোভ-২ যে চিনের গবেষণাগারেই তৈরী এমনই এক বধ্যমূল ধারণা তৈরি হয়েছে মানুষের মনে। যদিও প্রথম থেকেই বিষয়টি মানতে নারাজ চিন। তবে ওই ভাইরাস মে কোনো ভাবেই উড়ানের গবেষণাগার থেকে ছড়ায়নি শনিবার সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে মুখ খুললো উহানের সেই ভাইরাস গবেষণাগার উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি। 'এনবিসি নিউজ' সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়ে ডব্লিউআইভি-র সহকারী পরিচালক ঝিমিং ইউয়ান চিনের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারক সিজিটিএন-কে বলেছেন, “আমাদের থেকে ভাইরাসটি আসার কোনও উপায় নেই, আমাদের একটি কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং গবেষণার আচরণবিধি রয়েছে, তাই আমরা আত্মবিশ্বাসী।”
আর সুখের কথা, করোনায় তথ্যগোপন নিয়ে সোচ্চার ট্রাম্পকে খাটো করে যেমন চিনের পাশে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চিনের হয়ে সেভাবে পক্ষপাতিত্ব না করলেও একদিক থেকে অন্তত রেহাই দিতে চাইছেন একাধিক ভাইরাস বিশেষজ্ঞ। কারণ তাঁদের মতে সারস-কোভ -২-এর জেনেটিকালি উদ্ভাবন (পরীক্ষাগারে মানুষের তৈরী) করা হয়েছিল এই ধারণাটি একটি জোরদার ষড়যন্ত্র, অর্থাৎ গবেষণাগাড়ে এই ভাইরাস তৈরী করা হয়েছে, এই তত্ত্বের কোনো ভিত্তি নেই বলেই জানিয়েছেন তাঁরা। বেশ কয়েকজন ভাইরাস বিশেষজ্ঞের সঙ্গে এবিষয়ে কথা বলেছিল 'লইভসায়েন্স' সংবাদ মাধ্যম। তবে চিনা বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট করোনভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন এবং যা পরবর্তীকালে ল্যাব থেকে “পালিয়ে গেছে” এমন ঘটনা ঘটে থাকতেই পারে সে কথাও অস্বীকার করছেন না। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে এই ধরণের তত্ত্ব প্রমাণ করতে হলে এই সংক্রান্ত স্বচ্ছ তথ্য এবং খবরের প্রয়োজন যা চিনে ঘটছে না বলেই জানা গেছে। বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ লাইভ সায়েন্সকে বলেছেন এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যমকেও জানিয়েছেন যে সবথেকে বেশি সম্ভব্য বিষয়টি হল সারস-কোভ -২-এর সংক্রমণ প্রাকৃতিকভাবেই ঘটছে।
বোস্টন ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল ইমার্জিং ইনফেকশিয়াস ডিসিজ ল্যাবরেটরিজের সহযোগী পরিচালক জেরাল্ড কেউশ বলেছেন,”কোনও তথ্যের ভিত্তিতে না হলেও, কিন্তু সম্ভবত যা দেখা গেছে অনুমানের ভিত্তিতে তা হ'ল যে ভাইরাসটি বাদুড় থেকে কিছু স্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল (তবে ঠিক কোন প্রজাতির মধ্যে তা বর্তমানে অজানা), এবং সেখান থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, “সম্ভবত জীবন্ত প্রাণীর বাজারে প্রবেশের আগেই এই ভাইরাসের সংক্রমণের ঘটনাটি ঘটতে পারে, এই সংক্রমণ পরে আরও অনেক সংক্রমণের সাথে একটি পরিবর্ধক সমন্বয় হিসাবে কাজ করেছিল যা পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাকিটি ইতিহাস৷ সময়টা অস্পষ্ট এবং আমার মনে হয় না যে এই বিষয়গুলি কখন শুরু হয়েছিল সেবিষয়ে আমাদের কাছে সত্যিকারের কোনো তথ্য আছে। কারণ বড় অংশে তথ্য পরীক্ষার কাজে লাগানো হচ্ছে না৷’’
সারস-কোভিড -২ ভাইরাসটির সঙ্গে সেই কোরোনা ভাইরাসগুলির খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে নির্দিষ্ট প্রজাতির একধরণের বাদুড়ের দেহে পাওয়া যায় যা 'হর্স-সু ব্যাট' নামে পরিচিত। এই বাদুরগুলি চিনের উহান প্রদেশ থেকে প্রায় ১,০০০ মাইল (১,৬০০ কিলোমিটার) দূরে বসবাস করে। গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের মধ্যে প্রথম সারস-কোভ -২ এর প্রথম প্রাদুর্ভাব উহান শহরেই শুরু হয়েছিল এবং প্রথমে এটি একটি ভেজা সামুদ্রিক বাজারে (যা জীবিত মাছ এবং অন্যান্য প্রাণী বিক্রি করেছিল) সনাক্ত করা হয়েছিল, যদিও ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রাথমিক কিছু ক্ষেত্রে এই সংক্রমণের সঙ্গে সেই বাজারের কোনও যোগসূত্র নেই। সেখানে আরও বলা হয়েছে যে, বেশ কয়েকটি প্রস্তাবিত প্রজাতি যেমন সাপ থেকে শুরু করে পাঙ্গোলিন এমনকি কুকুরকে পর্যন্ত করোনা সংক্রমণের মধ্যস্থতাকারীদের তালিকায় রেখেছেন গবেষকরা, কিন্তু তাসত্ত্বেও একটি নির্দিষ্ট “মধ্যস্থতাকারীদের হোস্ট” খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁরা – যা বাদুড় থেকে মানুষের দেহে সারস-সিওভি -২ এর বহনকারী হিসেবে কাজ করছে। যদি 'হর্স-সু' বাদুড় প্রাথমিক হোস্ট হয় তবে এই ভাইরাস তাদের প্রকৃত বাসস্থান উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে কীভাবে কয়েকশ মাইল দূরের উহান শহরে চলে গেল?
তাই সবথেকে বড় প্রশ্ন হল এই ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে গবেষকদের অনেকেই যখন অন্যান্য জায়গায় খোঁজ খবর চালিয়ে যাচ্ছেন তখন তাদের মধ্যেই কেউ কেউ উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজর ওপরেই আলোকপাত করতে চাইছেন। ২০১৫ সালে, ডাব্লুআইভি চিনের প্রথম ল্যাব যা বায়োরিসার্চ সুরক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে বা বিএসএল -৪ এ পৌঁছেছে। যার অর্থ ল্যাব বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক রোগজীবাণু যেমন ইবোলা এবং মারবার্গ ভাইরাস সম্পর্কিত গবেষণা পরিচালনা করতে পারে। (সিডিসি-র মতে সারস-কোভি -২এর জন্য বিএসএল -৩ বা তারও বেশি সুরক্ষা প্রয়োজন) এইধরণের ল্যাবগুলিকে অবশ্যই কঠোর সুরক্ষা নির্দেশিকা অনুসরণ করতে হবে যার মধ্যে ল্যাব থেকে বেরোনোর আগে হাওয়া পরিশোধন করা, জল এবং বর্জ্যগুলি পরীক্ষা করে নেওয়া যেন কোনো ভাবে ভাইরাস না থেকে যায়। একইসঙ্গে এই বিশেষ ল্যাবগুলিতে প্রবেশ ও বেরোনোর আগে প্রধান করে পোশাক পরিবর্তন করে নিতে ডহয় গবেষকদের।
তখন প্রথম চিনে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়, তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপ-জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা ম্যাথু পোটিনগার চিনের ল্যাবগুলির সঙ্গে এর একটি সম্ভাব্য সংযোগ নিয়ে সন্দেহ করেছিলেনন বলে জানা গেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে জানুয়ারীর মাঝামাঝি সময়ে পোটিনগার সিআইআইএর মতো গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে, বিশেষত এশিয়া বিষয়ক এবং ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক অস্ত্র সম্পর্কে দক্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের এবিষয়ে তদন্ত করতে বলেছিলেন। তবে তখন তেমন কোনো প্রমাণ তাদের হাতে আসেনি। সুতরাং, সার্স কোভ-২ চিনের গবেষণাগারে মানুষের তৈরী ভাইরাস বা ভাইরাস অস্ত্র, এবার গবেষকদের এই ধারণা পাল্টাতে হবে। কারণ গবেষকদের দাবি বিস্তৃত আকারে প্রমানগুলি এটাই বলছে যে এই ভাইরাস সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক যা সম্ভবত বাদুড় বা অন্য স্তন্যপায়ী হোস্টের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।