ওয়াশিংটন: কক্ষপথের মধ্যে অবস্থিত সৌর জগতের সর্বাতিক্ষুদ্র এবং গ্রহাণু বলয়ের একমাত্র বামন গ্রহ বলা হয়। চাঁদের আয়তনের এক-তৃতীয়াংশ, মাত্র ৯৫০ কিলোমিটার ব্যাসের অধিকারী সেরেস গ্রহাণুপুঞ্জের সবচেয়ে বড় জ্যোতিষ্ক। ইতালির জ্যোতির্বিদ জিওসেপ্পে পিয়াজ্জি ১৮০১ সালের ১লা জানুয়ারি এটি আবিষ্কার করেন।
তিনি এর নাম রাখেন সেরেস ফেরদিনা যা সংক্ষেপে সেরেস। সেরেস নামের উৎস রোমান দেবী সেরেস যিনি অঙ্কুরোদগম, ফসল ফলানো এবং মাতৃ স্নেহের দেবী। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে এটাই বিশ্বাস করা হত এই গ্রহাণুটি মহাকাশে একটি বিশালাকার অনুর্বর পাথর। তবে একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে গ্রহাণু সেরেস এর ভূপৃষ্ঠের নীচে গলন্ত আগ্নেয়গিরি এবং তরল নোনতা জল রয়েছে যা অতীতে ভূগর্ভস্থ সমুদ্রের উপস্থিততি রয়েছে। যদিও এই জল পৃথিবীর সমুদ্রের জলের থেকেও ৮ গুণ বেশি লবণাক্ত।
গবেষণাটি নাসার রোবট মহাকাশযান ডন থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে করা সেরেস সম্পর্কে সাতটি গবেষনার একটি অংশ, যা প্রকাশিত হয়েছে নেচার অ্যাস্ট্রোনমি, নেচার জিওসায়েন্স এবং নেচার কমিউনিকেশন জার্নালে। এর মধ্যে দুটি গবেষণায় এমনই ইঙ্গিত মিলেছে যে সেরেসের বিশাল ওকেটর গর্তটিতে এমন পাঁচটি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতম চিহ্ন রয়েছে যা পাথুরে ভূত্বকের ভাঙা অংশ থেকে নোনতা জলে শুষে নেওয়ার ফলে সৃষ্ট।
সেরেস মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যবর্তী গ্রহাণু বলয়ের বৃহত্তম সত্ত্বা যার নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ রয়েছে, যার ফলে ডন তার ভূপৃষ্ঠের হাই-রেজোলিউশন ছবি পেতে সক্ষম হয়েছে। যেখান থেকে এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে যে সেরেসের ভূপৃষ্ঠের নীচে লবণাক্ত জলের জলাশয় রয়েছে এবং এখনও সেটি এটি একটি ভূগর্ভস্থ সমুদ্র হিসেবেই রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিজ্ঞানীদের একটি দল কক্ষপথ সম্পর্কিত ছবিগুলি বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, যা গ্রহাণুটির প্রায় ৩৫ কিলোমিটার (২২ মাইল) পর্যন্ত বিস্তৃত।
তারা ২০-মিলিয়ন বছর বয়সী ওকেটর গর্তটির ছবি খুঁটিয়ে দেখার পরেই নিশ্চিত হয়েছেন যে এর পৃষ্ঠের নীচে একটি বিশাল আকার জলাধার রয়েছে। ইনফ্রারেড ইমেজিং ব্যবহার করে, একধরণের যৌগ হাইড্রোহালাইটের উপস্থিতি আবিষ্কার করেছেন গবেষকরা। এটি সমুদ্রের বরফের মধ্যে সাধারণ একটি উপাদান যা এখনও পৃথিবীর বাইরে কোথাও দেখা যায়নি। ইতালির রোমের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গ্রহ বিজ্ঞানী মারিয়া ক্রিস্টিনা দে সান্টিস বলেন, হাইড্রোহালাইট হ'ল সেরেসে সমুদ্রের উপস্থিতির
একটি স্বচ্ছ প্রমান এবং এই খনিজগুলিতে জীবনের উদ্ভাবনের জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে। ডন মিশনের আর এক গবেষক জুলি কাস্টিলো-রোজেজের নেচার অ্যাস্ট্রোনমিতে একটি লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সেরাসের ভূপৃষ্ঠের নিচে জলের চলমান ক্রিয়া-কলাপের জন্য এই হাইড্রা হাইলাইট একটি 'স্মোক গান'এর মত কাজ করে। আর এই ক্রিয়াকলাপগুলিই অতিরিক্ত এবং স্বতন্ত্র প্রমাণ সেই গভীর সমুদ্র স্তরের যা সেরেসকে সমুদ্রের জগত হিসেবে পদোন্নত করছে।”
সর্বোপরি ডনের প্রধান গবেষক ক্যারল রেমন্ড যিনি ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডোনায় নাসা জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির কয়েকজনের গবেষকদের একটি দলের গবেষনার তদারকি করছেন তিনি জানিয়েছেন, “বর্তমান সময়ে বা কমপক্ষে খুব সাম্প্রতিক অতীতে, সেরেস ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় ছিল এবং তার সাপেক্ষে বেশ কয়েকটি জোরদার প্রমাণ রয়েছে।” মঙ্গল গ্রহে জলের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে। হিমায়িত বামন গ্রহ প্লুটোতেও সমুদ্র থাকতে পারে বলেই ইঙ্গিত মিলেছে গবেষণায়। শনির চাঁদ এনসেল্যাডাস এবং বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপায় সমুদ্রপৃষ্ঠ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, তবে সেগুলি সেরেসের লবণাক্ত জলের জলাধারগুলির চেয়ে অনেক বেশি উষ্ণ।
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সেরেস একটি সক্রিয় জগৎ – যদিও এটি এতটাই শীতল মে সূর্যের আলোতেও মাইনাস ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের তাপমাত্রা থাকে। ভূপৃষ্ঠের প্রায় ২৫ মাইল গভীরে সমুদ্রের জলস্তর এবং এখানে তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ৩১ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তবে এখানে জল জমে যাওয়ার প্রক্রিয়া অবিকল পৃথিবী এবং মঙ্গলের মত। তাই সেরেস নিয়ে নতুন গবেষণা ভবিষ্যতে বরফের উপস্থিতি আছে এমন গ্রহের খোঁজে গুরুত্বপূর্ণ।
একাধিক দেশের এমন একাধিক গবেষনায় সেরেসস-এ জলের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। আর জল মানেই সম্ভব্য জীবনের অস্তিত্ব। সেরেস নিয়ে গবেষনায় নতুন তথ্য অনুসারে সেখানে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ছাড়াও, কোনো এক পর্যায়ে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদান ছিল: তেমন, তরল জল, শক্তি এবং কার্বন বহনকারী জৈব অণু। ফলে ক্রমবর্ধমান পৃথিবীর তালিকায় এবার সেরেসও যুক্ত হল। বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে অল্প সময়ের জন্য সেরেস বসবাসযোগ্য হতে পারে।