ছিলেন যুদ্ধনায়ক, হলেন ভিলেন! কেন এমন পরিণতি গোতাবায়া রাজাপক্ষের?

ছিলেন যুদ্ধনায়ক, হলেন ভিলেন! কেন এমন পরিণতি গোতাবায়া রাজাপক্ষের?

 কলম্বো: শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ইতিহাসের সব থেকে চর্চিত পরিবার হল রাজাপক্ষে পরিবার। স্বাধীন এই দ্বীপ রাষ্ট্রের ইতিহাসের পাতায় পাতায় রাজাপক্ষে পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যের অজানা কাহিনীর কথা লুকিয়ে রয়েছে। একসময় এই পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে যুদ্ধনায়ক হিসেবে বর্ণনা করতেন দেশের নাগরিকরা। কিন্তু কালের নিয়মে এখন এই পরিবারে সদস্যরাই আজ শ্রীলঙ্কার সব থেকে সমালোচিত রাজনীতিবিদ। মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতার লোভ আর অপরিপক্ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এক সময়ের যুদ্ধনায়ক রাজাপক্ষে পরিবার কালের নিয়মে আজ ভিলেন। কিন্তু কি এমন ঘটল যা শ্রীলঙ্কার সব থেকে ক্ষমতাশীল পরিবারের সদস্যদের জন্য এমন ভয়াবহ দিন ডেকে আনল?

উল্লেখ্য, ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর শ্রীলঙ্কা যখন এযাবতকালের সবচেয়ে শোচনীয় অর্থনৈতিক সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন দেশটিতে এরকম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পরিস্থিতিকে আরও ভয়ংকর করে তুলেছে। জিনিসপত্রের দাম যেরকম বেড়ে গেছে, খাদ্য এবং জ্বালানির যে সংকট তৈরি হয়েছে, তাতে জনগণ এখন ক্রোধে ফুঁসছে। তার জেরেই এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ছিল যে পরিবারের বিরাট আধিপত্য, তাদের জন্য এটি এক বিরাট পতন। একসময় শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জাতিগোষ্ঠীর কাছে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ছিলেন বীর নায়ক। কারণ তিনি প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের নির্মমভাবে দমনের মাধ্যমে তিন দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি টেনেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপর যেসব বড় বড় বিজয় শোভাযাত্রা এবং জনসভা হয়েছিল, সেগুলোতে তাকে সিংহলি বৌদ্ধ রাজাদের সঙ্গে তুলনা করা হত।

বলে রাখা ভালো এই মাহিন্দার হাত ধরেই কিন্তু শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে পদার্পণ করেছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। ২০০৪ সালে যখন মাহিন্দা প্রধানমন্ত্রী হন তখন তাঁর ভাই গোতাবায়াকে তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে এই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থেকেই গোতাবায়া সরাসরি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে অসিন হন। কিন্তু দুই ভাইয়ের মধ্যে কখনো রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য না থাকার কারণে গোতাবায়া এবং মাহিন্দার সরকার চালাতে কোনদিনই কোন অসুবিধা হয়নি। তবে একা এই দুই ভাই নয় রাজাপক্ষে পরিবারের আরো বহু সদস্য শ্রীলঙ্কার রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

কিন্তু তাল কাটে সাম্প্রতিককালে যখন শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ আর্থিক সংকট দেখা দেয়। সেই সময় গোতাবায়া এবং মাহিন্দা রাজাপক্ষের সম্পর্কেও বড় চির ধরে। কারণ ভাই গোতাবারাই এক প্রকার জোর করে মাহিন্দাকে সমস্ত দায় নিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেছিলেন। এটা ছিল মাহিন্দার কাছে বড় একটি অপমান। কারণ একসময় মাহিন্দার হাত ধরেই শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে হাতেঘড়ি হয় গোতাবায়ার।

  এরপরেই একের পর এক চরম ভুল সিদ্ধান্ত নেন গোতাবায়া, যা তাকে তাঁরই পতনের দিকে  ঠেলে দিয়েছে। এপ্রিল এবং মে মাসে আর্থিক অনটনের জ্বালা সহ্য না করতে পেরে যখন শ্রীলঙ্কার আম জনতা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখাতে রাস্তায় নামে তখন এই গোতাবায়ার নির্দেশেই আন্দোলনকারীদের দাবির বিরোধিতা করতে সরকারপক্ষের বেশ কিছু লোককে রাস্তায় নামানো হয়েছিল। যা এক রাতের মধ্যেই গোটা দেশে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। এই সময় সরকার বিরোধী এবং সরকার পক্ষের মানুষেরা একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে এক রাতেই কমপক্ষে ২০ জনের প্রাণ যায়,  তাদের মধ্যে একজন সাংসদও ছিলেন। গোটা বিষয়টি নিজের রাজপ্রসাদে বসে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছিলেন গোতাবায়া। এমনকি সেই সময়ও তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকার করেছিলেন। এই হামলায় এক ডজনেরও বেশি রাজনীতিবিদের বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল বিক্ষুব্ধ জনতা। কিন্তু জনসাধারণের ক্রোধ নিবারণের বিন্দুমাত্র চেষ্টাই করেনি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট।

 এছাড়াও সমগ্র রাজাপক্ষে পরিবার যেখানে সবসময় দেশের কৃষক এবং সাধারণ জনগণের পক্ষে ছিলেন সেখানে গোতাবায়া বরাবরই ক্ষমতাসীন দল এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেয়ে বিত্তশালী জনগণের ভোট টানতেই আগ্রহী ছিলেন। মাহিন্দা রাজাপক্ষের বড় ছেলে নামাত রাজাপক্ষে সম্প্রতি গোতাবায়ার বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ উপড়ে দিয়ে এই সমস্ত কথাই প্রকাশ্যে এনেছেন।

অন্যদিকে বিশ্বস্ত সূত্রে খবর প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে এখনও ক্ষমতা ধরে রাখতে বেশ কিছু কূটনৈতিক চাল চলতে পারেন। মূলত সেই কারণেই তিনি পদত্যাগ করতে সময় নিচ্ছেন আর তাতেই শ্রীলঙ্কার বহু সাধারণ মানুষ ধৈর্য হারাচ্ছেন। অন্যদিকে রাজনীতিবিদদের একাংশের দাবি, স্থিতিশীল সরকার ছাড়া শ্রীলঙ্কার পক্ষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে নতুন ঋণ নেওয়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে যদি গোতাবায়া রাজাপক্ষে তড়িঘড়ি পদত্যাগ করে নতুন সরকার গঠনের রাস্তা প্রশস্ত না করে দেন তাহলে পরিস্থিতি আগামীতে আরও ভয়াবহ হবে এবং ভবিষ্যতে আরো বেশি বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সংকট দেখা দেবে দেশজুড়ে। কিন্তু তাতেও কোনো হেলদোল নেই শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্টের। কারণ এখনও তিনি দুদিনের সময় নিয়েছেন এবং জানাচ্ছেন আগামী বুধবার অর্থাৎ ১৩ জুলাই তিনি নিজের ইস্তফাপত্র জমা করতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 + 9 =