সামনে আরও বড় ‘মহামারী’, ভুয়ো চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞরা

সামনে আরও বড় ‘মহামারী’, ভুয়ো চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞরা

ওয়াশিংটন: করোনা রুখতে মরিয়া বিশ্বের প্রতিটি দেশ, সেখানকার রাজ্য এবং জেলাগুলি। আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা, অর্থনৈতিক মন্দা সব মিলিয়ে বিগত প্রায় চার মাসে মহামারীর কোনো সুরাহা নাহলেও বিষয়টি যেন কোনো এক অজ্ঞাত কারণে গাসওয়া হয়ে উঠেছে একশ্রেণীর মানুষের কাছে। আর তাই প্রাথমিক আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে এইশ্রেণীর মানুষগুলো স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই মেতে উঠেছে সুকৌশলে পরিস্থিতির ফায়দা লুটে নিতে। ফলে একটা অপ্রতিরোধ্য মহামারী বিশ্বের রাজনৈক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই যেন জোরদার প্রতিযোগিতার বাতাবরণ তৈরি করেছে।

চলছে দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের নজিরবিহীন সব পদক্ষেপ। তবে যে অদৃশ্য এক ভাইরাসের কারণে এত কান্ড সে তার প্রভাব বিস্তার করেই চলেছে। এই প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞেরা কিন্তু বিষয়টিকে মোটেই ভালো চোখে দেখছেন না। উল্টে তাঁরা সাবধান করে চলেছেন, পরামর্শ দিয়ে চলেছেন অদূর ভবিষ্যতের ভয়ঙ্কর পরিণামের বিষয়ে চিন্তা করে। যেমন এই মুহুর্তে সবথেকে বড় প্রতিযোগিতা করোনা মোকাবিলার ভ্যাকসিন আবিষ্কার। তবে তার আগে আপাতত বেশকয়েকটি ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায়। যার সবগুলোই পরীক্ষামূলক।

এর মধ্যে বেশিরভাগই নানান প্রাণদায়ী ওষুধ বা কোনো না কোনো সংক্রামক মারণ রোগের চিকিৎসার জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে বহুদিন আগে। অর্থাৎ সেই অর্থে বাজারে চলতি হলেও সাধারণ মানুষের ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। আর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি করতে অসৎ ওষুধ ব্যবসায়ীরা উঠেপড়ে লেগেছেন নিজেদের মুনাফা অর্জন করতে। ঘটনা নজরে আসতেই এপ্রিলের শুরুতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিন্তু প্রতিটি দেশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও এবিষয়ে সাবধান করেছিল যে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এইধরণের ওষুধের ব্যবহার সাধারণ মানুষের জন্য আরও ভয়াবহ পরিস্থিতিরর কারণ হয়ে উঠবে।  যদিও তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই দেশের সরকারের। আর এই পরিস্থিতিকে একজন বিশেষজ্ঞ  করোনার মতোই 'আরও এক মহামারী' বলে উল্লেখ করেছেন। এইমুহুর্তে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ওষুধ সরবরাহকারী দেশগুলির মধ্যে শীর্ষে চীন ও ভারত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মধ্যেই প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছে অনলাইনে ভুয়ো ওষুধ এবং মাস্ক,স্যানিটাইজারের মতো সুরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির রমরমা।

কিন্তু মহামারীর কারণে চারিদিকে এত অনিশ্চয়তা যে এই ধারণাগুলি করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকার জন্য মরিয়া গ্রাহকদেরও অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। মনোবিদেরও সতর্ক করেছেন যে এই অনিশ্চয়তাই এইধরনের নকল ওষুধ বা অনলাইনে প্রচার গুলিকে তাদের কাছে আরও বেশী করে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। করোনা মহামারী থেকে তৈরী আতঙ্ক থেকেই জালিয়াতরা নিজেদের লাভের সুযোগ করে নিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্টারনেটে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রদত্ত যে কোনও নিরাময়ের বিষয়ে আপাতত সাধারণ মানুষের সতর্ক হওয়া দরকার। ফেসবুক এবং টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি নিজদের আখের গোছাতে বিজ্ঞাপন পাওয়ার চেষ্টায় রয়েছে আর এই সুযোগে, হ্যাকার্সরাও দ্রুত লাভের আশায় গ্রাহক বাড়ানোর লক্ষ্যে মৌখিক প্রচার সহ অন্যান্য উপায় খুঁজে নিচ্ছে। সাইকোলজি টুডে'র এক প্রতিবেদন অনুসারে, ইন্টারপোল জানিয়েছে তাদের বিশ্বব্যাপী ওষুধ সংক্রান্ত অপরাধ দমনকারি শাখা, 'অপারেশন পাঙ্গিয়া', মাত্র সাত দিনের মধ্যে ৯০ টি দেশ জুড়ে ১২১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, যার মধ্যে ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি বিপজ্জনক ওষুধপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।  ইন্টারপোলের সেক্রেটারি জেনারেল জুরগেন স্টক সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘জনস্বাস্থ্যের এই সংকটকালে নকল চিকিৎসা সামগ্রীর এই অবৈধ ব্যবসা, জাতীয় ক্ষেত্রে  মানুষের জীবন সম্পর্কে একধরণের অবহেলা৷’’

প্রাথমিকভাবে উন্নতশীল দেশগুলি যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে এই ধরণের ওষুধের জালিয়াতরা এমন সমস্ত ওষুধ বিক্রি করছে যা সংক্রামক। এই ওষুধগুলির মধ্যে হয় ভুল নয়তো কার্যকরী নয় এমন সমস্ত উপাদান রয়েছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই ওষুধগুলি নির্দিষ্ট মেয়াদোত্তীর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সূত্রের বলছে স্বল্প এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলি এই ধরনের ওষুধ কিনতে ৩০ বিলায়ন ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয় করেছে। এই নকল ওষুধ প্রসঙ্গে হু-এর অন্যতম সদস্য পার্নেট বুর্ডিলিয়ন এস্তেভ বলেছেন, সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নকল ওষুধের নির্দিষ্ট রোগটির ওপর কোনও কার্যকরী প্রভাব পড়ে না। কিন্তু চিন্তার বিষয় হল এই ওষুধগুলির বিষাক্ত উপাদানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অন্য রোগর সংক্রমণ।

হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন কোভিড -১৯ এর চিকিৎসায় কার্যকর বলে এখনও নিশ্চিত প্রমাণের অভাব রয়েছে। তা সত্ত্বেও, অন্যান্য বিভিন্ন জায়গার সঙ্গে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো এবং ক্যামেরুনে বিপুল পরিমাণে নকল ক্লোরোকুইন পাওয়া গেছে। বিবিসি খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছে যে এই নকল ওষুধটি বেলজিয়ামের “ব্রাউন অ্যান্ড বার্ক ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড”এর তৈরী হয়েছে বলে অভিযোগ এবং এই নকল ওষুধের দাম আসল ওষুধের দামের থেকে অনেক বেশি। যদিও ব্রিটেনে ওই একই নামের যে আসল ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাটি রয়েছে তারা কিন্তু কোনোমতেই এই ওষুধ তৈরী করতে রাজী নয়।

ক্লোরোকুইনের উপাদান আছে মাছের অ্যাকোরিয়াম পরিষ্কারের জন্য ব্যবহৃত একধরনের কেমিক্যালে। করোনার হাত থেকে বাঁচতে এই কেমিক্যাল খেয়ে অ্যারিজোনায়  এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। আমাদের ভারতেও এক বৃদ্ধ দম্পতি দুজনেই এই কেমিক্যাল খেয়েছিলেন। এদের মধ্যে বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে বিশেষত কড়া ওষুধের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই এমন দেশে এজাতীয় আরও ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন নকল চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবসা বন্ধ  করতে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশ্বজুড়ে সমস্ত দেশের সরকারের মধ্যে আরও বৃহত্তর সমন্বয় প্রয়োজন। একই সাথে, ফেসবুকের মতো স্যোশাল সাইটগুলিতে ছড়িয়ে দেওয়া ভুল তথ্য এইধরণের ওষুধের চাহিদা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করছে।

জাল ওষুধের পাশাপাশি, রসুন, অলৌকিক খনিজ, মুহূর্তের মধ্যে ফল জানাতে পারে এমন  করোনভাইরাস টেস্টিং কিট, ঘরে তৈরী হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং ফেস মাস্কের মতো সন্দেহজনক প্রতিকারগুলি প্রচার করে বেড়াচ্ছে ব্যবসায়ী ফেরিওয়ালার দল। এমনকি সম্প্রতি একটি ওয়েবসাইট তো করোনভাইরাস ভ্যাকসিন কিট বিক্রির জন্য অনুমোদন দিয়ে জানিয়েছিল যে ওই ভ্যাকসিন কিট খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তৈরি।

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের চিকিৎসা নীতি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান আর্থার ক্যাপ্লানে্য মত বিশেষজ্ঞে নানান বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করার চেষ্টা করছেন।  তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “হোমিওপ্যাথিক বা পুষ্টিকর কিছুই নেই যা ভাইরাস থেকে আপনাকে বাঁচাতে পারে,” তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ইন্টারনেটের দৌলতে নানারকম চিকিৎসার সমাধান বা জাদু বা নিরাময়ের ধারণা ভেসে বেড়াচ্ছে যা সম্পূর্ণ বাজে ধারণা।” আপাতত, তিনি সতর্ক করেছেন, গ্রাহকদের অনলাইনে জিনিস কেনার ক্ষেত্রে, বিশেষত অজানা বিক্রেতাদের দেওয়া যেকোনও ধরণের পণ্য এড়িয়ে চলি উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *