বেজিং: যত দিন যাচ্ছে করোনার উৎসস্থল চিনের সেই উহান শহর যেন করোনা মানচিত্রে ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসছে। বরং সেখানে জাঁকিয়ে বসছে আমেরিকা, ইতালি, স্পেন,ফ্রান্সের মতো বিশ্বের উন্নত দেশগুলির অত্যাধুনিক শহরগুলির নাম। যদিও চিনে আতঙ্ক কাটেনি। নতুন করে ফিরে আসছে সংক্রমণ। তবুও স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে চিন, এই খবর এখন বিশ্বের অন্যান্য করোনা কবলিত দেশগুলির মধ্যে চরম কৌতূহল সৃষ্টি করছে। এই মারণ ভাইরাসকে কোন মন্ত্রবলে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হল চিনের মত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটি তার নিয়ে শুরু হয়েছে জোর জল্পনা। গবেষকরাও যেমন নিজেদের গবেষণার পাশাপাশি চিনের গবেষণারও খোঁজখবর রাখছেন। তেমনই আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলিও সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে করোনা নির্মূলের কোনো একটি গোপন চিনা সূত্রের সন্ধান পেতে। এপর্যন্ত চিনে করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে ওষুধগুলির ব্যবহার সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে তার একটা ধারণা দেওয়া যাক।
রেবেডেসিভির: ৫ ফেব্রুয়ারি, 'আউটলুক'-এর প্রতিবেদন অনুসারে, চিনে করোনা সংক্রামণের প্রথম পর্যায়ে ক্যালিফোর্নিয়ার গিলিয়েড সায়েন্সের তৈরী 'রেবেডেসিভির' নামে একটি ওষুধ তৈরির জন্য ছাড়পত্র চেয়ে সংস্থাকে চিঠি পাঠায় উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি। রেবেডেসিভির ইবোলা এবং সার্স সহ সংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত একটি অ্যান্টিভাইরাল থেরাপি। ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে দেখা যায় ২১ শে জানুয়ারি একটি সামরিক একাডেমি সহ এই আবেদন করা হয়েছিল। ততদিনে প্রায় ৪৯০ জন করোনা আক্রান্তের মৃত্যু হয়েছে চিনে।
ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন-এর ভেষজ পানীয়: ১৬ মার্চ, 'লাইভমিন্ট'-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, করোনার চিকিৎসায় চিনের বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি আয়ুর্বেদিক পানীয় ব্যবহার করা হয়েছে, এটি একটি তরল পানীয় হিসেবে খেতে দেওয়া হত। এর মধ্যে এফেড্রা, দারুচিনি ও যষ্টীমধু সহ ২০ ধরণের ভেষজের ব্যবহার করা হয়।যা শরীরকে বিষমুক্ত করে। ফেব্রুয়ারি মাসে চিনের করোনা আক্রান্ত অন্তত ৬০ হাজার রোগীকে এই পানীয় দেওয়া হয়। চিনের ন্যাশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিনের উপ-প্রধান ইউ ইয়ানহং জানিয়েছেন, ওই সময় চিনে করোনা ৫০ হাজার করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই এই পানীয় খেয়েছিল। তিনি বলেন ২০০২-২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই পানীয় অত্যন্ত সফল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
ফভিপিরাবির: ১৮ মার্চ 'দ্য গার্ডিয়ান' জাপানের এক সংবাদ মাধ্যমের তথ্য উল্লেখ করে লিখেছে, 'ফভিপিরাবির' নামে জাপানে প্রচলিত ফ্লু-এর একটি ওষুধ চিনের করোনা আক্রান্তদের ওপর ক্লিনিকাল পরীক্ষায় দারুন কার্যকরী বলে দাবি করা হয়েছে। চিনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের আধিকারিক ঝাং জিনমিন বলেছেন, 'ফভিপিরাবির' টোয়ামা কেমিক্যাল (ফুজি ফিল্মের অংশ) দ্বারা নির্মিত অ্যান্টিভাইরাল এবং এই ওষুধ উহান ও শেনজেনে ৩৪০ জন করোনা আক্রান্তের ওপর প্রয়োগ করা হয়।
টোকিলিজুমব/অ্যাক্টেমেরার: ২৫ মার্চ 'ডেইলি মেইল'- এর একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়, চিনে করোন ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আর্থ্রাইটিসের একটি ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে। এর দ্বারা করোনা আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ৯৫ শতাংশ সেরে উঠছেন বলে বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন। টোকিলিজুমব যা অ্যাক্টেমেরার নামে বাজারে প্রচলিত এই ওষুধ রিউম্যাটয়েড (দেহের অংশবিশেষ ফুলে ওঠা) বাতজনিত রোগীদের ব্যাথা কমানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী। টোকিলিজুমব প্রাপ্ত বয়স্কদের রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের পাশাপাশি শৈশবকালীন নির্দিষ্ট ধরণের আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসার জন্যেও ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত সুইজারল্যান্ডের ফার্মাসিউটিকাল ফার্ম রোচে প্রযোজিত রোআ্যাক্টেমেরা এবং অ্যাক্টেমেরার নামে প্রচলিত একটি ওষুধ।প্রতিবেদন অনুসারে, তখনই এই ওষুধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোগীদের ওপর পরীক্ষার জন্য গ্রিন সিগন্যাল দেয় এফডিএ।
ট্যান রে কিং: ২৫ মার্চ, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, খাদ্যবস্তু হিসেবে জীবন্ত বন্য প্রাণীদের ব্যবসা ও ব্যবহার দেশে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে, চিন সরকার মারাত্মক ও জটিল কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রামণের চিকিৎসার জন্য ভালুকের পিত্ত, ছাগলের শিংয়ের পাউডার এবং বেশকিছু ভেষজ উদ্ভিদ যুক্ত একটি ইনজেকশন 'ট্যান রে কিং' ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে। এই ইনজেকশন এটি চিনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন দ্বারা ৪ মার্চ প্রকাশিত করোনভাইরাস চিকিৎসায় ব্যবহার্য ওষুধের একটি তালিকায় এই ইনজেকশনের উল্লেখ ছিল।
ক্যালেট্রা: ৯ এপ্রিল, রয়টার্স- এর প্রতিবেদন অনুসারে, করোনা মহামারীর প্রথমদিকে উৎস শহর চিনের উহানে গুরুতর করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসায় যুক্ত চিকিৎসকদের মতে এইচআইভি ড্রাগ ক্যালেট্রা ব্যবহার করে ভালো ফল পেয়েছিলেন তাঁরা। জানুয়ারি থেকে এই ওষুধের ব্যবহার শুরু হয় উহানের হাসপাতালে। উহানের জিনিনটান হাসপাতালের সভাপতি,ঝুং ডিঙ্গ্যু বলেছেন ক্যালেট্রা, অ্যাবভি দ্বারা উৎপাদিত লোপিনাভির / রিটোনাভিরের একটি অফ পেটেন্ট সংস্করণ, পাশাপাশি দ্বিতীয় ওষুধ হিসেবে ছিল বিসমথ পটাসিয়াম সাইট্রেট, এই ওষুধ গুলোই তাঁরা প্রেস্ক্রাইব করতেন। এর ফলাফল ভালো ছিল বলেই দাবি করেছেন তিনি।
সবশেষে যে ওষুধটির কথা না বললেই নয় তা হল ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। কারণ এখনও পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ফ্রান্সের একটি গবেষণা ছাড়া কোনো দেশের সরকার বা গবেষকরা এই ওষুধটিকে করোনা চিকিৎসার জন্য ছাড়পত্র দিতে চাইছেন না। বরং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে তারা বেশি চিন্তিত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বিশ্বের একাধিক দেশে করোনার প্রভাব যত শক্তিশালী হয়েছে, ততই বেড়েছে এই ওষুধের চাহিদা। উল্লেখযোগ্যভাবে করোনার উৎসস্থল চিনের সাফল্যের কোনো ক্ষেত্রেই যে ওষুধটিকে সেই অর্থে কখনোই প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। একাধিক সংবাদ মাধ্যম ও জার্নালে এই ওষুধ নিয়ে চিনের তেমন কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
থাইল্যান্ড মেডিক্যাল নিউজ: এর প্রতিবেদন অনুসারে, সাংহাইয়ের সংক্রমণ ও প্রতিরোধ অধিদফতরের, সাংহাই জনস্বাস্থ্য ক্লিনিকাল সেন্টার, ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের গবেষণা বলছে করণা নির্মূল করতে ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথায় 'ঈশ্বরপ্রদত্ত' হলেও এখনো পর্যন্ত গবেষণায় এই ওষুধের তেমন কার্যকরী ফল পাওয়া যায়নি।
ব্লুমবার্গ-এর প্রতিবেদন অনুসারে চিনের ঝিজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে করোনা আক্রান্তদের যে রোগীদের ওপর হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন প্রয়োগ করা হয়নি তাদের সঙ্গে তুলনায়, এই ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে এমন রোগীদের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য বোঝা যায়নি। উহান ইউনিভার্সিটির রেনমিন হাসপাতালের এমডি, ঝান ঝাং ও সহকর্মীরাও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনকে করোনা চিকিৎসার ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন না।