বৈরুত বিস্ফোরণের অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট অনেক ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়

বৈরুত বিস্ফোরণের অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট অনেক ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়

তপন মল্লিক চৌধুরী: লেবাননের রাজধানী বৈরুতে গুদামজাত করা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনাটি  ঘটেছে মাত্র ৪ সেকেণ্ডের মধ্যে। রাসায়নিকটি মূলত ব্যবহৃত হয় সার উৎপাদনে। এছাড়া খনিতে বিস্ফোরক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। তবে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিজে কোনও বিস্ফোরক পদার্থ নয়, তবে কিছু অবস্থায় তা বিস্ফেরকে পরিণত হতে পারে। এটি আসলে অক্সিডাইজার মানে যা আগুনে আরও অক্সিজেন টেনে আনে এবং আগুন আরও বেশি জ্বলে ওঠে।

বৈরুতের বিস্ফোরণ মনে করিয়ে দেয় ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার অ্যাটোমিক বোম ফ্যাট বয়ের কথা। তবে বৈরুতের বিস্ফোরণটি ফ্যাট বয়ের এক-পঞ্চমাংশ ক্ষমতাসম্পন্ন। পাশাপাশি মনে পড়ে ১৯৮৬-র ২ এপ্রিল চেরনোবিল দুর্ঘটনার কথা। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৪৭ সালে টেক্সাসে। ২ হাজার ৩০০ টন সার বহনকারী একটি জাহাজে ওই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় অন্তত ৫০০ মানুষ। ওই বিস্ফোরণে এতটাই শক্তি ছিল যে সমুদ্রে ১৫ ফুট উঁচু ঢেউ সৃষ্টি হয়েছিল। শুধু তাই নয়, জাহাজের দেড় টন ওজনের নোঙরটি ছিটকে গিয়ে পড়েছিল প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে।

ওই দুর্ঘটনার পর থেকে রাসায়নিক উৎপাদন ও পরিবহনে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়, বিশেষ করে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সুরক্ষিত কন্টেইনার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু তারপরও ২০০৪ সালে ইরানে একটি মালবাহী ট্রেনে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে বিস্ফোরণে প্রাণ হারান অন্তত ৩০০ জন। যার তাণ্ডবে ধ্বংস হয়েছিল একটা গোটা গ্রাম। ২০১৫ সালে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় তিয়ানজিন উপকূলে আরেকটি বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৭৩ জন, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন দমকলকর্মী।

১৯৭০ সালে উইসকনসিনের ম্যাডিসনে স্টার্লিং হল বোমা হামলা, ১৯৯৫ সালে ওকলাহোমা সিটি বোমা হামলা, ২০১১ দিল্লি বোমা হামলা, ২০১১ সালে অসলোতে বোমা হামলা এবং ২০১৩ সালে হায়দরাবাদ বিস্ফোরণে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবহৃত হয়েছে। বৈরুতের বিস্ফোরণে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে বৈরুত বন্দর। প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৩৫ জন, আহত কয়েক হাজার। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়ছে। দেশটি এমনিতেই অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছিল, এবার চরম মানবিক সংকটেরও মুখোমুখি হয়েছে তারা।

অ্যামোনিয়া নাইট্রেট তেল বা ওই জাতীয় কিছু সংস্পর্শে কোনওভাবে দূষিত হয়ে গেলে তখন সেটা   বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে। আর তারপর আগুনের সংস্পর্শে এলে এটি অত্যন্ত সক্রিয় বিস্ফোরক হিসেবে কাজ করে। আর বিস্ফোরিত হলে তখন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং অ্যামোনিয়ার মত বিষাক্ত গ্যাস বের হতে থাকে। একটি সভ্যতা গড়ে উঠতে কয়েক শতাব্দী সময় লাগে কিন্তু শেষ হতে সময় লাগে মাত্র এক সেকেন্ড। আ্যামোনিয়াম নাইট্রেট যেমন কৃষি উৎপাদনে দরকার হয়; সার উৎপাদনে অপরিহার্য ভুমিকা রাখে, তেমনি ধ্বংস যজ্ঞেও তার ভূমিকা ভয়ংকর।

বৈরুতের ঘটনার পরই জানা যায় চেন্নাই বন্দরে বেশ কয়েক বছর ধরে মজুত রয়েছে বাজেয়াপ্ত হওয়া ৭৪০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। তামিলনাড়ুর এক বাজি তৈরির সংস্থা, ২০১৫-তে অবৈধ ভাবে আমদানি করেছিল ওই বিপুল পরিমাণ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। চেন্নাই বন্দরে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল সেই বিস্ফোরক।মজুত থাকা প্রায় ৭৪০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিষ্ক্রিয় ব্যাপারে শুল্ক বিভাগের এক সিনিয়র অফিসার বলেছেন, সাতভা কন্টেনার ডিপোতে ওই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব সেগুলি নিষ্ক্রিয় করা হবে। সেই কাজ শুরুও হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × 3 =