টাটা গ্রুপের উত্তরসূরী? (Shantanu Naidu Ratan Tata Protege)
মুম্বাই: “বেস্ট ফ্রেন্ড” ছিলেন রতন টাটা! “বাতিঘর” হারিয়ে গোটা শান্তনুর গোটা পৃথিবী অন্ধকার! কিভাবে গড়ে উঠেছিল অসমবয়সী বন্ধুত্ব? রতনের ছায়া সঙ্গীর আসল পরিচয় জানেন? এই শান্তনুই কি তাহলে টাটা গ্রুপের উত্তরসূরী?
শান্তনু নাইডু। রতন টাটার অফিসের কনিষ্ঠতম জিএম, জেনারেল ম্যানেজার। কিন্তু সেটাই শুধুমাত্র তাঁর পরিচয় নয়। আর ঠিক এই কারণেই, আজ শান্তনুর চারিপাশে শুধুই শূন্যতা।
মহীরুহ শিল্পপতির ‘প্রিয় বাতিঘর’ বছর ত্রিশের শান্তনু লিঙ্কডিনে একটা বিদায়ী পোস্ট শেয়ার করে লিখেছেন তাঁর জীবনে রতন টাটার ফেলে যাওয়া এই শূন্যস্থান পূরণ করা সম্ভব হবে না। ‘এই বন্ধুত্বে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করার চেষ্টায় আমার বাকিটা জীবন কেটে যাবে। ভালোবাসার দাম মেটাতে হয় বিষাদে। বিদায় আমার প্রিয় বাতিঘর।’ সঙ্গে দুজনের বিমান যাত্রার একটা ছবি।
প্রিয় বন্ধু (Who is Shantanu Naidu?)
হ্যাঁ, আসলে শান্তনু ছিলেন রতন টাটার প্রিয় বন্ধু। কিন্তু টাটা গোষ্ঠীর এক সময়ের চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাঁর আলাপ হল কী ভাবে? সাল ২০১৪, এই অসমবয়সী বন্ধুত্বের শুরু। দু’জনেই পশুপ্রেমী। আর সেই সূত্রেই তাঁদের ঘনিষ্ঠতা। পশুপ্রেম তাঁকে এবং শান্তনুকে কাছাকাছি এনেছিল।
একসময় রতন টাটা শান্তনুকে তাঁর হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। কিন্তু সেই কাজ থেকে বন্ধুত্ব, মাঝখানের গোটা জার্নিতে কি এমন ঘটলো যে অবিবাহিত রতন টাটা চলে যাওয়ার পর চারিদিকে যখন জল্পনা, টাটা গোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ দায়িত্বভার কার হাতে পড়তে চলেছে? তখন সম্ভাব্য উত্তরসূরীদের মধ্যে রতন টাটার বেস্ট ফ্রেন্ড শান্তনু রয়েছেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে? কেন শান্তনু বারবার লাইমলাইটে এসেছেন?
বিগত ১০ বছর ধরে রতন টাটার হয়ে কাজ করেছেন শান্তনু নাইডু। বিগত কয়েক বছরে শারীরিক ভাবে ভেঙে পড়েও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন রতন টাটা। সেক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে শান্তনু নাইডুকে দেখা গেছে সবসময়। এমনকি রতনের জন্মদিনেও পাশে ছিলেন শান্তনু। এক কথায় শান্তনু হয়ে উঠেছিলেন রতন টাটার ছায়াসঙ্গী।
দিবাস্বপ্ন ছিল (Key milestones in Shantanu’s career)
শান্তনু নাইডু পুণের বাসিন্দা শান্তনু এক জন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। পড়াশোনা পুণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। শান্তনু টাটা এলেক্সিতে কাজ শুরু করেন এক জন জুনিয়র ডিজ়াইনার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। তখন টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান ছিলেন রতন টাটা। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব তো দূর অস্ত্ নজরে পড়াও দিবাস্বপ্ন ছিল তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে। তবে সুযোগ তৈরি হয়। সংস্থার জুনিয়র কর্মী। রাতের ডিউটিই থাকত বেশি। কাজের ফাঁকে রাস্তার কুকুরদের দেখভাল করতেন। সেই সময়েই শান্তনু খেয়াল করেন তাঁর অফিস চত্বরে প্রায়ই কিছু কুকুর গাড়ি চাপা পড়ে মারা যায়। ঘটনাগুলো ঘটে মূলত রাতের দিকে। পশুপ্রেমী জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার ঠিক করেন এর সমাধান করবেন।
শান্তনু ঠিক করেন রাস্তার কুকুরদের আলো জ্বলা কলার পরানো হবে। যাতে রাতের অন্ধকারেও তাদের দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু কলার বানাবে কে? কেই বা পরাবে?
রাস্তার কুকুরদের দেখভালের জন্য সমমনস্কদের নিয়ে তৈরি করে ফেলেন একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘মোটোপজ়’। এই ‘মোটোপজ়’-ই জীবন বদলে দেয় শান্তনুর। সংস্থা তৈরি হলেও টাকা ছিল না। কলার যে বানানো হবে তার জিনিস আসবে কোথা থেকে! বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছেঁড়া জিন্স জোগাড় করে আনেন শান্তনুরা। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে তাতে জোড়া হয় অন্ধকারে জ্বলে এমন কাপড়। তৈরি হয় কলার। শান্তনুদের এই উদ্যোগ পুণের টাটা এলেক্সি কর্তৃপক্ষের নজর কাড়ে। সংস্থার নিউজ়লেটারে জায়গা করে নেয় ঘটনাটা। নজরে পড়ে তৎকালীন চেয়ারম্যান রতন টাটারও। রতন নিজেও পশুপ্রেমী। তাঁর সংস্থার এক কর্মীর এমন উদ্যোগের কথা জেনে রতন নিজেই যোগাযোগ করেন শান্তনুর সঙ্গে। তাঁদের কাজকর্মের বিশদ জানাতে বলেন।
সেই শুরু। শান্তনুর সঙ্গে দেখা হয় রতন টাটার। তাঁদের সংস্থাকে অর্থসাহায্য করেছিলেন রতন। তবে টাটা গোষ্ঠীর তরফে নয়। শান্তনুদের তিনি সাহায্য করেছিলেন ব্যক্তিগত ভাবে। সম্পূর্ণ নিজের অর্থ থেকে। এর পরে ইমেলে প্রায়শই কথা হতে থাকে দু’জনের। প্রথমে তাঁদের সংস্থার কাজ নিয়ে, পরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিষয়ে ভাবনাচিন্তা বিনিময়, এমনকি একটা সময়ে ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্নোত্তরের পর্যায়েও পৌঁছে যায় কথাবার্তা। তবে টাটার সঙ্গে সম্পর্কে এর পর কিছু দিনের জন্য ছেদ পড়ে শান্তনুর। চাকরি ছা়ড়েন তিনি। উচ্চশিক্ষার জন্য পুণে থেকে আমেরিকায় পাড়ি দেন। ভর্তি হন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ঘটনাচক্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন রতন টাটাও। টাটার সঙ্গে সম্পর্কে ছিঁড়লেও দুই বন্ধুর যোগাযোগে ছেদ পড়েনি। শান্তনুর গ্র্যাজুয়েশনের শেষ দিন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন রতন। সে দিনই শান্তনুকে তাঁর সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেন। রতন টাটার ব্যক্তিগত বিজনেস অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ শুরু করেন শান্তনু। গাঢ় হতে থাকে দুই অসমবয়সীর বন্ধুত্ব।
ধারণাও দিতেন শান্তনু (Mental Wavelength Match)
রতনকে নতুন স্টার্টআপ সংস্থার ব্যাপারে নিত্যনতুন ধারণাও দিতেন শান্তনু। সেই সব ভাবনার বেশ কয়েকটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগও করেন রতন। এমনকি টাটা গোষ্ঠী কোন কোন নতুন ক্ষেত্রে নিজেদের ডানা মেলতে পারে সে ব্যাপারেও রতনকে নিয়মিত তত্ত্বতালাশ দিতেন তাঁর বন্ধু তথা সহকারী শান্তনু। এর পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর নিজের ভাবনাচিন্তাগুলোকে রূপ দেওয়ার কাজও।মোটোপজ়ের মতোই আরও কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে শান্তনুর। সেই প্রচেষ্টার নাম ‘গুড ফেলা’। তাঁর আর রতনের মতোই বয়স্কদের সঙ্গে সমমনস্ক কমবয়সিদের জোড়ার ভাবনা। যাতে দু’পক্ষই ভাল থাকেন। একে অপরের সংস্পর্শে সমৃদ্ধ হন।
শুধু অফিসের কাজ নয়, শান্তনু ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রামের কোথায় কোন হ্যাশট্যাগ দিতে হবে, কোন ইমোজির মানে কী, এ সব ব্যাপারেও বন্ধুকে চোস্ত করে তুলেছিলেন। মধ্য আশির শিল্পপতির ইনস্টাগ্রাম অনুরাগীর সংখ্যা যে এখন পাঁচ লক্ষ পার করেছিল তা সেই প্রশিক্ষণের দৌলতেই। বন্ধুর উৎসাহে রতন নিজেও নিয়মিত ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করতেন।
সেই বন্ধু রতনকে নিয়ে অলরেডি একটা বইও লিখে ফেলেছেন শান্তনু। বইয়ের নাম ‘আই কেম আপন আ লাইটহাউস’। বন্ধু রতনের সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন মুহূর্তের কথা, তাঁদের দু’জনের বন্ধুত্বের কথা শান্তনু লিখেছেন সেই বইয়ে। তবে বই না বলে ডায়েরি বলাই ভাল।
শান্তনু জানিয়েছেন, রতনের সঙ্গে কাটানো তাঁর মুহূর্তগুলি তাঁর মা তাঁকে একটি ডায়েরিতে লিখে রাখতে বলেছিলেন। তবে বন্ধুত্ব যত বেড়েছে সংখ্যা বেড়েছে ডায়েরির। তাঁর বই সেই ডায়েরির পাতা থেকেই সটান তুলে আনা। একসঙ্গে সিনেমা দেখা, ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজেদের চিন্তাভাবনার সহজ বিনিময়। সেই বন্ধুত্বে ছেদ পড়ল। বুধবার রাতে প্রয়াত হয়েছেন রতন টাটা। দেশের অন্যতম শিল্পপতিকে হারাল ভারত। আর শান্তনু হারালেন তাঁর ‘বাতিঘর’। যদিও শান্তনু উত্তরসূরী হবেন এমন কোনও খবর এখনো সামনে আসেনি।
তবে একবার বলেছিলেন, রতনের যে বিষয়টা শান্তনুকে বিস্মিত করত, তা হল তাঁর লক্ষ্যে স্থির থাকা। শান্তনুর কথায়, ‘‘উনি টানা কাজ করে যেতে পারেন। নন-স্টপ। নো ব্রেক।’’ কিন্তু এবার পার্মানেন্ট ব্রেক নিলেন শান্তনুর বেস্ট ফ্রেন্ড।
আরও পড়ুন..
রতন টাটাকে শেষ শ্রদ্ধা মুকেশ-নীতার, পৌঁছলেন আকাশ-শ্লোকা আম্বানিও
National – Shantanu Naidu Ratan Tata Protege : Meet Shantanu Naidu, Ratan Tata’s protege and rising star in Indian business. Learn about his journey, achievements, and vision for the future.