অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ট্র্যাকে নেমে রুপো জয়, পিটি ঊষাকে দিতেন টক্কর, কেমন আছেন সেই সাইনি?
কলকাতা: বছর পাঁচের আগের কথা। গোটা দুনিয়াকে অবাক করে ট্র্যাকে নেমেছিলেন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্তা মার্কিন ডিসটান্স রানার অ্যালিসিয়া মোন্টানো৷ তাঁর সহসিকতায় মুগ্ধ হয়েছিল ক্রিড়া জগত৷ এর আগেও অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় দৌড়েছিলেন এই অ্যাথলিট। কিন্তু জানেন কি, ট্র্যাকে এমন সাহসিকতার নজির এ দেশেও আছে। তবে হালফিলের ঘটনা নয়। কথা হচ্ছে আশির দশকের। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এশীয় স্তরের অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় পা রাখার ‘সাহস’ দেখিয়েছিলেন এই রানার। শুধু তাই নয়, প্রতিযোগিতা থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন রুপোর মেডেল। তিনি আর কেউ নন, সাইনি কুরিসিঙ্গল আব্রাহাম। মা হওয়ার পর আবারও ট্র্যাকে ফিরে গিয়েছিলেন একদা পিটি ঊষাকেও টক্কর দেওয়া এই অ্যাথলেট। সাইনির ঝুলিতে এমন সব ‘নজির’ রয়েছে, যা অনেককেই অবাক করে।
আরও পড়ুন- দুর্ঘটনার ১৭ দিন পর প্রথম টুইট এল ঋষভের থেকে, কী বললেন ক্রিকেটার
আশির দশকে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ইভেন্টে দেশীয় তারকাদের কথা উঠলেই চারটি নাম ভেসে ওঠে। তাঁরা হলেন- পিটি ঊষা, সাইনি আব্রাহাম, এমডি বালসাম্মা এবং বন্দনা রাও। অধিকাংশ সময়েই দেশের পতাকার ভার বহনের দায়িত্ব সামলাতেন ভারতের এই কন্যা। তবে সবচেয়ে বেশি ফোকাস কাড়তেন ঊষা এবং সাইনি। কারণ, বহু ক্ষেত্রেই পিটি ঊষার সঙ্গে সাইনির তুলনা টেনে পাতার পর পাতা লিখতেন ক্রিড়া সাংবাদিকরা৷
আশির দশকে এ দেশের আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে ঘরসংসার করা কিংবা নিশ্চিন্তের চাকরির পিছনে ছোটেননি সাইনি৷ বরং বেছে নিয়েছিলেন অ্যাথলেটিক্সকে৷ ছোট থেকে সে দিকেই টান ছিল তাঁর৷
ঊষার মতো সাইনিও কেরলের বাসিন্দা। ১৯৬৫ সালের ৮ মে কেরলের আইডুক্কি জেলার জন্ম তাঁর। ঊষা তাঁর চেয়ে বয়সে বছর খানেকের বড় হবে। ছোটবেলায় কেরলের কোট্টয়ামের স্পোটর্স ডিভিশনে ভর্তি হয়েছিলেন সাইনি। সেখানেই অ্যাথলেটিক্সে হাতেখড়ি হয় তাঁর। তিরুবনন্তপুরমের জিভি রাজা স্পোর্টস স্কুলেও বেশ কিছু দিন প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন৷ এর পর পলইয়ের আলফোন্সা কলেজে ভর্তি হন৷
ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ৪০০ এবং ৮০০ মিটারের ইভেন্টে পিটি ঊষার সঙ্গেই কেরিয়ার শুরু হয়েছিল সাইনি আব্রাহামের। ১৯৮২ সালে নয়াদিল্লিতে এশীয় গেমসের আসরে এক সঙ্গে দেখা গিয়েছিল ভারতের এই দুই প্রতিভাবান অ্যাথলেটকে৷ সেই প্রতিযোগিতার আগের বছরেই ৮০০ মিটারে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন সাইনি। বলা যায়, জাতীয় স্তরে ৮০০ মিটারের দৌড়ে নিজের দক্ষতাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন সাইনি। দীর্ঘ ১৪ বছরের কেরিয়ারে প্রতি বছরই জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় ৮০০ মিটারের ইভেন্টে পদক জিতেছেন কেরল-কন্যা৷
১৯৮৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলসে বসেছিল অলিম্পিক্সের আসর৷ সে বারই প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে অলিম্পিক্স ইভেন্টের সেমিফাইনালে পৌঁছন সাইনি। ৮০০ মিটার ট্র্যাকে ২.০৪.০৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে চতুর্থ স্থান দখল করেন৷
লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক্সে আরও একটি মাইলফলক ছুঁয়েছিলেন সাইনি। ৪X৪০০ মিটার রিলে রেসে ঊষা, বালসাম্মা এবং বন্দনার সঙ্গে ভারতীয় দলের সদস্য ছিলেন তিনি। তাঁরা ফাইনালে উঠলেও জিততে পারেননি। পরের বছর অপেক্ষা করছিল আরও চমক৷ এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ৮০০ মিটারে সোনা ছিনিয়ে নেন সাইনি৷ ৪০০ মিটারের দৌড়ে জেতেন রুপো৷
১৯৮৫ সালে হয় এশিয়ান গেমস৷ তাতে অবশ্য সকলকে নিরাশ করেছিলেন তিনি৷ সোলে এশিয়ান গেমসের ৮০০ মিটারের দৌড়ে সকলের থেকে এগিয়ে থাকলেও সোনা হাতছাড়া হয় তাঁর। দৌড়ের শেষে জানা যায়, নির্ধারিত সময়ের আগেই লেন বদল করে ফেলেছিলেন সাইনি। সেই নিয়মেই ‘ডিসকোয়ালিফাই’ হয়ে যান৷ তবে সোল এশিয়াডের ৪০০ মিটারের ইভেন্টে ঊষার পিছনে শেষ করে রুপো জেতেন তিনি৷
তবে খেল দুনিয়ার মানুষরা বলে থাকেন, সাইনির কেরিয়ারের সেরা মুহূর্ত ১৯৮৯-এর এশীয় ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড প্রতিযোগিতা। ওই প্রতিযোগিতায় ৮০০ মিটারের দৌড়ে রুপোর পদক জেতেন তিনি৷ তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সে সময় পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন সাইনি।
এশীয় ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড প্রতিযোগিতার আগের বছরই ডিসেম্বর মাসে সাঁতারু উইলসন চেরিয়ারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন তিনি৷ মা হওয়ার পর আবারও ট্র্যাকে ফেরেন সাইনি। শুধু ফিরেই আসেননি, প্রথম সন্তান শিল্পার জন্মের পর নাকি ট্র্যাকে তাঁর গতি আরও বেড়ে গিয়েছিল। ১৯৯৫-এর সাফ গেমসে ৮০০ মিটারের দৌড় তিনি শেষ করেছিলেন ১.৫৯.৮৫ সেকেন্ডে। যা ছিল সেই সময়ের নতুন রেকর্ড।
’৯২-এর বার্সেলোনা অলিম্পিক্সেও নিজের ছাপ ফেলেছিলেন এই দক্ষিণী অ্যাথলেট৷ তিনি ট্র্যাককে বহুদিন আগেই বিদায় জানিয়েছেন৷ কিন্তু এখনও অনেকের মনেই তিনি বিরাজ করেন। এশিয়ান গেমসে ১টি সোনা ও ব্রোঞ্জ এবং ২টি রুপো রয়েছে সাইনির ঝুলিতে। অন্য দিকে, এশিয়ান ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ৭টি সোনা, ৫টি রুপো এবং ২টি ব্রোঞ্জ রয়েছে তাঁর। কেরিয়ারের মধ্যগগনে থাকাকালীন ১৯৮৫ সালে অর্জুন পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় সাইনিকে। ১৯৯৮ সালে সম্মানিত হন পদ্মশ্রী সম্মানে।
কিন্তু, এককালে ট্র্যাকে ঝড় তোলা সাইনি আজকাল কী করছেন জানেন? ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (এফসিআই)-র নানা টুইটে দেখা মেলে তাঁর। আশির দশকে সাড়া জাগানো এই অ্যাথলিট এখন উচ্চপদস্থ আধিকারিক। চেন্নাইয়ে এই কেন্দ্রীয় সংস্থার পশ্চিমাঞ্চলীয় অফিসে জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তিনি৷