কলকাতা: তালিবানের রক্তচক্ষুতে তখন কাঁপছে দেশ৷ চারিদিকে বন্দুকের আস্ফালন৷ সেই তালিবানের চোখেই ধুলো দিয়ে ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে দেশ ছেড়েছিল মেয়েটি৷ একদা আফগানিস্তানের উদ্বাস্তু শিবিরে ঠাঁই নেওয়া সেই মেয়েই আজ সে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফুটবলার৷ শুধু তাই নয়, ৩৪ বছরের নাদিয়াকে সর্বকালের সেরা আফগান মহিলা ফুটবলারের তকমাও দিয়েছেন অনেকে।
আরও পড়ুন- আলবিদা! আন্তর্জাতিক টেনিস থেকে অবসর নিতে চলেছেন সানিয়া মির্জা
শুধু ফুটবল মাঠেই দাপিয়ে বেড়াননি নাদিয়া৷ পাঁচ বছরের কঠিন পরিশ্রমে ডাক্তারিটাও পাশ করে ফেলেছেন তিনি৷ ক্লাব বা আন্তর্জাতিক স্তরে ফুটবল পায়ে দৌড়ে বেড়ানোর পাশাপাশি সমান তালে ডাক্তারি পরীক্ষার প্রস্তুতিও চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি৷ পরীক্ষায় পাশ করার পরেই টুইট করে তাঁর অগণিত শুভানুধ্যায়ীকে ধন্যবাদ জানান নাদিয়া।
সালটা ২০০০৷ নাদিয়া তখন ১১ বাছরের বালিকা৷ একদিন খবর এল তাঁর বাবা রাবানি নাদিমকে তুলে নিয়ে গিয়েছে তালিবান জঙ্গিরা৷ রাবানি ছিলেন আফগান সেনারই জেনারেল। কিন্তু সে দিনের পর থেকে আর বাবার মুখ দেখতে পাননি নাদিয়া। খবর আসে, কোনও এক মরুভূমিতে নিয়ে গিয়ে রাবানিকে নাকি ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিয়েছে তালিবানরা। এর পরেই মেয়েদের নিয়ে হেরটের ভিটেমাটি ছাড়বেন বলে মনস্থ করেন নাদিয়ার মা হামিদা। কিন্তু সেই সময় দেশ ছাড়া অত সহজ কাজ ছিল না৷ তালিব জঙ্গিদের রীতিমতো বোকা বানিয়ে ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে চার বোন আর মায়ের সঙ্গে দেশ ছাড়েন নাদিয়া৷ একদা তালিবানকে বোকা বানানো নাদিয়া খেলার মাঠেও বিপক্ষের প্রতিরোধ ভেঙে গোলকিপারকে বিভ্রান্ত করে গোলের পর গোল করে চলেন৷ তাঁর পায়ের যাদুতে মুগ্ধ অগণিত অনুরাগী৷
ডাক্তারি পাশ করার পর নাদিয়া লিখেছেন, ‘‘প্রথম দিন থেকে আমার পাশে থাকার জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানাই। চলার পথে অনেক নতুন বন্ধু পেয়েছি৷ তাঁদের সাহায্য ছাড়া এই পথ চলা সম্ভব হত না। আমার উপর ভরসা করার জন্য আমি চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকব!’’
দেশে যা কিছু ছিল, সবকিছু বেচে ভুয়ো পাসপোর্ট বানিয়ে পাকিস্তানে চলে আসেন নাদিয়ারা। সেখান থেকে ট্রাকে করে পাড়ি দেন সোজা ইটালি। তার পর লন্ডন। সব শেষে পৌঁছন ডেনমার্কে। ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে নাদিয়া একবার বলেছিলেন, ‘‘আফগানিস্তানে জীবন ছিল যুদ্ধময়৷ বাবাকে খুন করা হয়েছিল। স্মৃতিগুলো একেবারেই মধুর নয়৷ প্রায় সবটাই অশান্তি আর ভয়ে ভরা। আফগানিস্তানে আমাদের ভবিষ্যৎও সুরক্ষিত ছিল না।’’
আফগানিস্তান থেকে ডেনমার্কের একটি ছোট্ট গ্রামে শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই নিয়েছিল নাদিয়ারা। ওই শরণার্থী শিবিরের মাঠেই ফুটবল অনুশীলন করত ছোট ছোট মেয়েরা। মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে বিস্ময় ভরা চোখে তাঁদের দেখতেন নাদিয়া৷ খেলা দেখতে দেখতেই নিজের অজান্তে ফুটবলের নেশা ধরে যায় তাঁর। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন বড় ফুটবলার হওয়ার৷ নাদিয়া বলেন, ‘‘ওদের দেখে ভাবতাম আমিও একদিন মাঠে নমাব৷ আমিও ফুটবলার হব৷’’
আমতা আমতা করেই এক দিন শিবিরের ফুটবল কোচের কাছে নিজের ইচ্ছের কথা জাহির করেছিলেন নাদিয়া। সেই ইচ্ছায় আমল দিয়েই শুরু হয়ে যায় অনুশীলন৷ কয়েক মাস পর ফুটবল মাঠে অভিষেক হয় নাদিয়ার। নাদিয়া বলেন, ‘‘হঠাৎ করেই আমার প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়। এর পর ওয়ার্ম-আপ ম্যাচ, ড্রিল, সবকিছু করতে থাকি৷ বেশ কিছুটা সময় তো বুঝতেই চলে গিয়েছিল৷’’
শরণার্থী শিবিরে থাকা নাদিয়াকে একদিন আশ্রয় দেয় ডেনমার্ক সরকার৷ বদলে যায় তাঁর জীবন৷ ২০০৫ সালে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ডেনমার্কের প্রথম শ্রেণির ক্লাব বি৫২ আলবর্গের জার্সি ওঠে তাঁর গায়ে। ওই বছরের শেষেই তিনি যোগ দেন টিম ভাইবর্গে৷ এর পর প্রায় ১০ বছর ধরে ডেনমার্কের বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলেছেন নাদিয়া। যখন যে দলে গিয়েছেন, সেই দলের ভরসাযোগ্য স্ট্রাইকার হয়ে উঠেছেন।
এর পর ২০০৯ সাল৷ নাদিয়ার জীবনে আসে সেই চরম মুহূর্ত৷ যখন ডেনমার্কের জাতীয় দলের জার্সি পরে মাঠে নামেন নাদিয়া নাদিম। প্রসঙ্গত, নাদিয়াই হলেন ডেনমার্কের প্রথম ফুটবলার যিনি জন্মসূত্রে ডেনিশ নন। কিন্তু ডেনমার্কে ভালোবেসে ফেলেন নাদিয়া। ডেনমার্কের হয়ে ৯৯টি ম্যাচ খেলেছেন৷ মোট ৩৮টি গোল রয়েছে তাঁর।
২০১৪ সালে আমেরিকার স্কাই ব্লু দলের হয়ে খেলতে নামেন এই আফগান তরুণী৷ ২০১৮ সালে লেখা হয় নাদিয়ার ফুলবল জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায়৷ সে বছর উইমেন্স সুপার লিগে ম্যানচেস্টার সিটি-র জার্সি ওঠে তাঁর গায়ে৷ সেখানে বেশ কয়েক মাস কাটিয়ে ২০১৯ সালে নাদিয়া যোগ দেন প্যারিস সঁ জঁ-তে৷ ওই দলে ভাইস-ক্যাপ্টেনও হন তিনি। সঁ জঁ-তে থাকাকালীন প্রথম বার লিগ খেতাব জেতে তাঁর দল। ২৭ ম্যাচে ১৮টি গোল করেছিলেন নাদিয়া৷ গত জুনে আমেরিকার লিগ ফুটবলে রেসিং লুইভিল ক্লাবের হয়ে খেলেন তিনি।
খেলার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের মেডিক্যাল কেরিয়ার নিয়েই সিরিয়াস ছিলেন নাদিয়া৷ পাশাপাশি তিনি বরাবর সরব হয়েছেন আফগান নারী ও শিশুদের অধিকার রক্ষায়৷ সেই দাবিতেই গত বছর রাষ্ট্রপুঞ্জ-সহ নানা স্থানীয় সংগঠনের হয়ে ২৯ হাজার পাউন্ড তুলতে সাহায্য করেন নাদিয়া। তাঁর দেশের মেয়েরা যে তালিবানি শাসনে কোনঠাসা সে তা নিয়েও মুখ খুলেছেন এই ফুটবল তারকা৷