তপন মল্লিক চৌধুরী: ফুটবল নিয়ে ঘটি-বাঙালদের রেষারেষি ১০০ বছরের ব্যাপার। সুরেশ চৌধুরী বা তড়িৎ ভূষণ রায় প্রমুখ বাঙালরা যখন ক্লাব তৈরি করবেন ঠিক করলেন, তখন ঢাকা বা অন্য কোনও পূর্ববঙ্গীয় শহরকে কেন বেছে না নিয়ে কলকাতার কথা ভাবলেন? তাঁরা তো স্বচ্ছন্দে ঢাকা শহরেই ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন।
প্রসঙ্গত, ইষ্টবেঙ্গল ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তড়িৎ ভূষণ রায় ছিলেন ব্যারিস্টার। তাঁর বাড়ি ছিল উত্তর কলকাতার কুমোরটুলিতে। ইষ্ট বেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠার প্রথম মিটিংটি হয়েছিল সেই বাড়িতেই; ঝুলন উৎসবের দিন। ঢাকার ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, ওয়ারী প্রভৃতি ক্লাবের নাম তখন গোটা বাংলা জানে। রংপুরের তাজহাট স্পোর্টিং তখন কলকাতার লিগে দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলছে। ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব ঢাকায় তৈরি হলে কলকাতার লিগও খেলত সেই সঙ্গে জনসমর্থন বেশি পেত। কিন্তু তাঁরা তা করলেন না। কেন?
তাতে মোহনবাগানকে যথাযথ শিক্ষা দেওয়া হত না। সেটা সুরেশ চৌধুরী বা তড়িৎ ভূষণ রায় প্রমুখ বাঙালদের মনে হয়েছিল। তখন থেকেই কলকাতার বিশেষ করে উত্তর কলকাতার লোকেরা অচ্ছেদ্দা করে পূর্ববঙ্গীয় মানুষদের বাঙাল বলতো। হয়ত তাই কলকাতায় বসেই মোহনবাগানকে শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছাটা মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠেছিল সুরেশ চৌধুরী বা তড়িৎ ভূষণ রায়দের মতো বাঙ্গালদের কাছে। ঘটিদের পাড়ায় বসে যদি ঘটিদের উচিত শিক্ষা না দেওয়া যায় তাহলে আর কিসের লড়াই কিসের জিৎ।
মোহনবাগান ক্লাব পূর্ববঙ্গ থেকে ফুটবলার নিয়ে আসবে আর বুক ফুলিয়ে বড়াই করবে, ফুটবল নিয়ে বড় বড় বুকনি মারবে এটা বেশি দিন চলতে দেওয়া যায় না। তাই বাঙাল ফুটবলারদের জন্য জন্ম দেওয়া হল ইষ্টবেঙ্গল ক্লাব। আর জন্ম নেওয়া মাত্র মোহনবাগান ক্লাবের বাকত্তালা দেওয়া মুখ বন্ধ করল মোহনবাগানকে হারকিউলিস কাপে হারিয়ে।
বাঙালদের ইষ্টবেঙ্গল ক্লাবের ন’বছর আগে জন্ম নেওয়া কলকাতার অভিজাত ঘটিদের ক্লাব মোহনবাগান ১৯১১ সালে ইংরেজদের ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতেছিল। সেটা কেবলমাত্র ইতিহাস নয়, গর্বের এবং ঐতিহ্যেরও বটে। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক জয়ের নেপথ্যে যে আটজন পূর্ববঙ্গীয় ফুটবলার ছিল সে কথা কি কখনো মোহনবাগান কিংবা ঘটিরা বুক বাজিয়ে বলে?
ঢাকা থেকে সেদিন প্রচুর বাঙাল শিল্ড ফাইনালের ম্যাচটা দেখতে কলকাতা এসেছিলেন। দেশ তথা মোহনবাগানকে উৎসাহ দিতে, সমর্থন করতে। কিন্তু কোনও বাঙাল কোনওদিন দাবি করেননি, সেই ঐতিহাসিক কৃতিত্বের মূলে ছিলেন তাঁদের আট জন। কিন্তু ঘটিরা সেই অবদানের কথা মুখেও আনেন না। আভিজাত্যের গর্বে ঘটিরা বরং বাঙালদের আবেগে সুযোগ পেলেই আঘাত দিয়ে ফেলেন।
জন্মলগ্নে মোহনবাগান ক্লাবের প্রতীক ছিল বসে থাকা একটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। ইংরেজরা মোহনবাগান ক্লাব কর্তাদের ভয় দেখাল, ‘তোমরা তোমাদের ক্লাবের প্রতীক বদলে ফেল। টিপু সুলতানের সেনাবাহিনীর প্রতীক টাইগার। ইংল্যান্ডে কর্তাদের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছতে পারে। তখন যে তোমরা রাজরোষে পড়বে না, সে কথা কে বলতে পারে?’ ব্যাস ভীতু ঘটি কর্মকর্তারা সাত তাড়াতাড়ি মোহনবাগানের প্রতীক বদলে নৌকা করে ফেলল।
অন্যদিকে ইংরেজদের সন্তুষ্ট করার কোনও দায় ছিল না বাঙ্গালদের। ক্লান্মের সময় থেকে প্রায় দশ বছর ইষ্টবেঙ্গল ক্লাবের কোনও প্রতীকই ছিল না। জন্মের প্রায় এক দশক পরের ঘটনা। ইংরেজ ফুটবল কর্তাদের অন্যায় দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য ইষ্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্মকর্তা ও সমর্থকেরা ময়দানের তাঁবু থেকে মিছিল করে আইএফএ অফিস পর্যন্ত গিয়েছিলেন এক সন্ধ্যায়। অন্ধকার পথে তাঁরা হাতে নিয়েছিলেন জ্বলন্ত মশাল। সেই অন্যায়ের প্রতিবাদের পরে জ্বলন্ত মশাল আরও অর্থবহ হয়ে ইষ্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতীক হয়ে যায়।