ধ্যানচাঁদ: হিটলারও তার খেলা দেখে জার্মানির নাগরিক হতে বলেছিলেন

ধ্যানচাঁদ: হিটলারও তার খেলা দেখে জার্মানির নাগরিক হতে বলেছিলেন

a0dff7a7479f294761a324d8d911a73b

তপন মল্লিক চৌধুরী: তাঁর একক নৈপুণ্যে ভর করেই ভারত ১৯২৮, ’৩২ এবং ’৩৬ সালের অলিম্পিকে হকিতে সোনা জিতেছিল। ওই তিনটি অলিম্পিকে ৩৩টি গোল করেছিলেন তিনি। সেই সময়টা ছিল ভারতীয় হকির স্বর্ণযুগ। বলের ওপর তাঁর হকি স্টিকের অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার জন্য তাঁকে বলা হত হকির জাদুকর।

প্রায় সমস্ত দেশই একটা সময়ে বলত ধ্যানচাঁদের হকি স্টিকে আঠা লাগানো থাকে। একবার এমন হল যে মাঠে ধ্যানচাঁদ তাঁর স্টিকে বলকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রনে রেখেছেন যে প্রতিদ্বন্দ্বী নেদারল্যান্ডস-এর কর্মকর্তারা ধ্যানচাঁদের হকিস্টিক ভেঙে দেখেছিলেন। কিন্তু সেখানে চুম্বক বা আঠা জাতীয় কিছু পান নি। একবার এক ম্যাচে কিছুতেই গোল পাচ্ছিলেন না ধ্যানচাঁদ। তাঁর সন্দেহ হয়। তিনি রেফারিকে গোলপোস্টের উচ্চতা নিয়ে অভিযোগ জানান। মেপে দেখা যায় সত্যি নির্দিষ্ট মাপের থেকে গোলপোস্টের উচ্চতা কম।

এলাহাবাদে প্রয়াগের একটি রাজপুত পরিবারে জন্ম ধ্যানচাঁদের। বাবা সমেশ্বর দত্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ছিলেন এবং হকি খেলতেন। বাবার বদলির চাকরির জন্য ধ্যানচাঁদের পড়াশোনা বেশ বিঘ্নিত হয়। ক্লাস সিক্সের পরে ছেদ পড়ে ধ্যানচাঁদের পড়াশোনায়। সেনাবাহিনীতে কাজের দৌলতে এক ফালি জমি পেয়ে অবশেষে তাঁর বাবা থিতু হন মধ্যপ্রদেশের ঝাঁসিতে।

আশৈশব হকির প্রতি কোনও আকর্ষণ ছিল না ধ্যানচাঁদের। ভালবাসতেন কুস্তি।  স্বপ্ন ছিল কুস্তিগীর হওয়ার। যদিও ছেলেবেলায় ধ্যানচাঁদের কোনও খেলার প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল না। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে উল্লেখ করার মতো হকি খেলেছেন বলে তার মনে হয়নি। ১৬ বছর বয়সে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেনাবাহিনীর দলে সুযোগ পান। ধীরে ধীরে হকির প্রতি ভালবাসা জন্মায়।  শোনা যায়, পেশাগত কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ধ্যানচাঁদ অনুশীলন শুরু করতেন না। সে সময় রাতে ফ্লাডলাইটের ব্যবস্থা ছিল না। ডিউটি শেষ হওয়ার পর ধ্যানচাঁদ অনুশীলন করতেন রাতে। অপেক্ষা করতেন কবে পূর্ণিমা ও শুক্লপক্ষ আসবে।  চাঁদের আলোয় বেশিক্ষণ অনুশীলন করতে পারবেন।  সেই থেকে তাঁর নাম হয় ধ্যানচাঁদ। তাঁর খেলায় বিস্মিত বিদেশি সংবাদমাধ্যম তাঁকে জাদুকর বলে অভিহিত করে।

বিশ্বের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান ডন ব্র্যাডম্যান বলেছিলেন, উনি যে গতিতে রান করেন, সেই একই গতিতে নাকি গোল করেন ধ্যানচাঁদ। ধ্যানচাঁদের খেলা দেখে হিটলার এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে তাঁকে জার্মানি নাগরিকত্বের প্রস্তাব দেন। পাশাপাশি জার্মান সেনাবাহিনীতে কর্নেলের পদও তাঁকে অফার করা হয়। বিশ্বের দরবারে বারবার চক দে ইন্ডিয়া বলেছিল তাঁর হাতের স্টিক। ১৯৪৮ সালে তিনি শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন। আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে তার গোলের সংখ্যা চারশোর বেশি।  তাঁকে সম্মান জানিয়ে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় তৈরি হয়েছে মূর্তি | চার হাতে চারটি হকি স্টিক ধরে আছেন ধ্যানচাঁদ। লন্ডনে টিউব স্টেশনগুলোর মধ্যে ৬ টি নামাঙ্কিত করা হয়েছে প্রখ্যাত হকিস্টদের নামে। তাঁদের মধ্যে আছেন তিনজন ভারতীয়- ধ্যানচাঁদ সিং, তাঁর ভাই রূপ সিং এবং লেসলি ক্লডিয়াস।  

শেষ বয়সে জর্জরিত ছিলেন শারীরিক সমস্যায়। চিকিত্‍সক জিজ্ঞাসা করেছিলেন ভারতীয় হকির ভবিষ্যত্‍ কী ? ধ্যানচাঁদ বলেছিলেন, এই দেশে হকি শেষ।  কারণ ছেলেরা শুধু খেতে চায়।  কাজ করতে নয়।  এরপরেই কোমায় চলে যান তিনি। দেশ ও দেশবাসীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে শেষ জীবনে শুধু আশঙ্কা ছিল, তাঁর পদকগুলো যেন ঘর থেকে চুরি না হয়ে যায়।  কারণ এমনই তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়েছিল তাঁর।

হকির এই জাদুকরের জন্মদিন দেশ জুড়ে পালিত হয় জাতীয় ক্রীড়া দিবস রূপে। এদিনই রাজীব খেলরত্ন, অর্জুন পুরস্কার, দ্রোণাচার্য পুরস্কার-এর মতো সম্মান প্রাপকদের হাতে তুলে দেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় মৃত্যু হয়েছিল এই কিংবদন্তির। ভরসা বলতে ছিল সামান্য পেনশন।  ক্রীড়া জগতে জীবনভর সম্মানের জন্য ২০০২ সাল থেকে দেওয়া হয় ধ্যানচাঁদ সম্মান। ২০১৪ সালে তাঁকে মরণোত্তর ভারতরত্ন সম্মানে সম্মানিত করার প্রস্তাব এসেছিল। জোরালো হয়েছিল দাবি।  কিন্তু সে বছর ভারতরত্ন দেওয়া হয় ক্রিকেটার শচীন তেন্ডুলকার ও বিজ্ঞানী সি.এন.আর রাও-কে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *