পেলে নাকি মারাদোন? সেরা কে? বিশ্বজুড়ে চলতেই থাকবে তর্ক! কিন্তু আপনার কাছে কেই বা সেরার সেরা?

পেলে নাকি মারাদোন? সেরা কে? বিশ্বজুড়ে চলতেই থাকবে তর্ক! কিন্তু আপনার কাছে কেই বা সেরার সেরা?

কলকাতা: দু’জনেরই জন্ম অক্টোবর মাসে। দু’জনেই লাতিন আমেরিকার দুই দেশের দরিদ্র পরিবারের সন্তান। দু’জনেই বুঝিয়ে দিয়েছেন বছর, দশক বা শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে তাঁদের নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। একজন এডসন অ্যারান্তেস ডো ন্যাসিমেন্তো, যিনি গোটা বিশ্বে পরিচিত পেলে নামে। অন্যজন দিয়াগো আর্মান্দো মারাদোনা।

মারাদোনা আগেই প্রয়াত হয়েছেন। এবার ৮২ বছর বয়সে চলে গেলেন পেলে। এক কথায় বলা যায় বিশ্ব ফুটবল অভিভাবক শূন্য হয়ে গেল। মারাদোনার আবির্ভাবের আগে নিঃসন্দেহে পেলেকেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু ১৯৮৬ সালে মারাদোনা একার দক্ষতায় যেভাবে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন তারপর থেকেই তাঁর সঙ্গে পেলের তুলনা হতে শুরু করে।

বস্তুত গোটা ফুটবল দুনিয়া পেলে এবং মারাদোনা, এই দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কেউ মনে করেন মারাদোনা সর্বকালের সেরা, আবার উল্টো দিকে পেলেকেই সর্বকালের সেরা বলে মনে করেন বাকি অংশ। এই তর্ক চলতেই থেকেছে। আর চলতেই থাকবে। কিন্তু ফুটবল বিশেষজ্ঞরা মনে করেন তাঁরা দুই প্রজন্মের ফুটবলার হওয়ায় এভাবে তুলনা করা উচিত নয়। আসলে দু’জনেই তাঁদের সময়কার বিশ্বসেরা। যদিও বিশ্বকাপ জেতার নিরিখে মারাদোনার চেয়ে এগিয়ে আছেন পেলে। পেলে তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছেন। কিন্তু মারাদোনাকে একবার জিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। আর ক্লাবের হয়ে খেলে দু’জনেই অসাধারণ সাফল্য পেয়েছেন। দেশের হয়ে ৯২ ম্যাচে ৭৭ টি গোল করেছেন পেলে। বিশ্বকাপে ১৪টি ম্যাচে করেছেন ১২টি গোল।

সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে ১৭ বছর ২৪৪ দিনের মাথায় ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করেছেন পেলে। সব মিলিয়ে পেলে ১২৮৩টি গোল করেছেন। যে রেকর্ড এখনও কেউ ভাঙতে পারেননি। উল্টো দিকে মারাদোনা দেশের হয়ে ৯১টি ম্যাচে ৩৪টি গোল করেছেন। বিশ্বকাপে ২১টি ম্যাচ খেলে মারাদোনা করেছেন ৮টি গোল। তবে পেলে এবং মারাদোনা দু’জনেই কেউ কখনও কোপা আমেরিকা কাপ জেতেননি।

তবে শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে মারাদোনাকে বিচার করা যাবে না। মারাদোনার গোল সংখ্যা কম থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আসলে মারাদোনা পুরো টিমটাকে খেলাতেন, গোল করাতেন, আবার নিজেও গোল করতেন। বস্তুত মারাদোনাকে রোখা খুবই কঠিন কাজ ছিল ডিফেন্ডারদের পক্ষে। তাঁকে সব সময় চার থেকে পাঁচজন বিপক্ষের ফুটবলার কড়া নজরে রাখতেন। আর সেই সুযোগে আর্জেন্টিনার অন্যান্য খেলোয়াড়রা গোল পেয়ে যেতেন। এটাই মারাদোনার মাহাত্ম্য।

পেলের সঙ্গে মারাদোনার তুলনা করতে গেলে আরও একটি কথা বলতেই হবে। সেটা হল দলগত শক্তি। পেলের পাশে যারা খেলতেন সেই গ্যারিঞ্চা, ভাভা, ডিডি, নিলটন স্যান্টোস, জোয়ারজিনহো, এমন আরও অনেকে রয়েছেন যাদের প্রতিভা কোনও অংশে কম ছিল না। ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে পেলে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলে চোট পাওয়ায় আর খেলতে পারেননি। সেই বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দেন গ্যারিঞ্চা। তাঁর ফুটবল শিল্প ধ্বংস করে দেয় বিপক্ষ দেশগুলির রক্ষণকে। ১৯৫৮ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে নেমে পেলে তাঁর  জাত চিনিয়েছিলেন। তখন তাঁর পুরো ১৮ বছর বয়স হয়নি। আর ১৯৬২ সালে ট্রফি ধরে রাখার দায়িত্ব নিয়েছিলেন গ্যারিঞ্চা। সেবারেও হইহই করে দ্বিতীয় বার বিশ্বকাপ জিতে নেয় ব্রাজিল। এরপর ১৯৭০ সালে পেলে ফের প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তিনি কোন মানের ফুটবলার।‌ পেলে সতীর্থদের পাশে নিয়ে দুর্দান্ত ফুটবল খেলে আবার বিশ্বকাপ এনে দেন ব্রাজিলকে।

 
অন্যদিকে মারাদোনা ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ পাওয়ার পর পরের বিশ্বকাপেও দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন। কিন্তু পেলে পাশে যে সমস্ত খেলোয়াড়দের পেয়েছিলেন তুলনায় মারাদোনার সহ খেলোয়াড়রা ততটা উঁচু মানের ছিলেন না। ক্যানিজিয়া, বুরুচাগা, ভালদানোর মতো কয়েকজন ছাড়া বাকিরা অসাধারণ মানের ছিলেন না বলেই ফুটবল বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে ১৯৯০ সালের ফাইনালে জার্মানি বিতর্কিত পেনাল্টি গোলে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দেয়। সেই ম্যাচে মেক্সিকোর রেফারি কোডেসাল যে পেনাল্টির নির্দেশ দিয়েছিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন আজও থেকে গিয়েছে। এছাড়া পেলে ও ম্যারাদোনার তুলনা করতে গেলে আরও একটি বিষয় অবশ্যই  সামনে চলে আসবে। পেলে দুই পায়েই শট মারতে পারতেন, আর হেডেও দক্ষ ছিলেন। সেখানে মারাদোনা হেড ও ডান পায়ে দক্ষ ছিলেন না। অর্থাৎ মারাদোনা কমপ্লিট ফুটবলার ছিলেন না পেলের মতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা বলতে হবে যে, বিপক্ষের ফুটবলাররা সবাই জানতেন মারাদোনার শুধু বাঁ পা আটকে দিলেই কেল্লাফতে। তিনি যা করবেন শুধুমাত্র বাঁ পা দিয়েই করবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মারাদোনাকে আটকানো যেত না।

এছাড়া ড্রিবলিংয়ের ক্ষেত্রে মারাদোনা কিন্তু পেলের থেকে অনেকটাই এগিয়ে থাকবেন। মারাদোনা যেভাবে বিপক্ষের ফুটবলারদের কাটিয়ে বক্সে উঠে সহ খেলোয়াড়দের গোলের পাশ বাড়াতেন, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এক্ষেত্রে পেলের থেকে এগিয়ে থাকবেন মারাদোনা। তাই সবশেষে বলতেই হচ্ছে পেলে ও মারাদোনার তুলনা হয় না। তাঁরা দুজনেই নিজের সময়কার বিশ্ব সেরা ফুটবলার। পেলে ফুটবল সম্রাট হলে মারাদোনা বিশ্ব ফুটবলের রাজপুত্র হিসেবেই থেকে যাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *