বেজিঙ: পৃথিবী যেমন সূর্যের চারদিকে ঘোরে, তেমনই চাঁদ ঘোরে পৃথিবীর চারদিকে। দু জনেই এভাবে ঘোরার সময়ে নিজে পাক খেতে থাকে। এ তো সবারই জানা। কিন্তু দু জনের এই ঘোরার মধ্যে আছে পার্থক্য। সেই পার্থক্যের কারণেই পৃথিবীর দুই গোলার্ধেই প্রতি ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পড়ে সূর্যের আলো। অর্থাৎ দুই গোলার্ধই ২৪ ঘণ্টা অন্তর সূর্যের মুখোমুখি হয়। ঘুরিয়ে বললে, সূর্য প্রতি ২৪ ঘণ্টায় এক বার পৃথিবীর পূর্ব গোলার্ধকে দেখতে পায়, আরেক বার দেখতে পায় পশ্চিম গোলার্ধকে। কিন্তু চাঁদের শুধু এক দিকই দেখা যায় পৃথিবী থেকে। যে দিকটি পৃথিবীর নজরের আড়ালে থেকে যায়, তাকে বলা হয় চাঁদের অন্ধকার দিক। না, আলো পড়ে না বলে অন্ধকার দিক নয়। ওই দিকটির প্রায় সবটুকুই পৃথিবী থেকে অদৃশ্য থাকে বলে এমন পরিচিতি। সেই দিকটিকেই এই মুহূর্তে জানতে বুঝতে ব্যস্ত চীনের চন্দ্রযান চাঙ ই ফোর। চীনের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা চায়না অ্যাকাডেমি অব স্পেস টেকনোলজির অন্যতম আধিকারিক এবং চাঙ ই ফোর প্রকল্পের কার্যনির্বাহী অধিকর্তা ঝাঙ হে রবিবার দেশের সংবাদ সংস্থা সিনহুয়াকে জানিয়েছেন, জানুয়ারির শুরু থেকেই চাঙ ই ফোর চাঁদের তথাকথিত অন্ধকার দিকে গবেষণা চালাচ্ছে। এবার এই চন্দ্রযান ওই দিকে রাতের হিমাঙ্ক মাপবে। উল্লেখ্য, গত ৩ জানুয়ারি চাঁদের অন্ধকার দিকের মাটিতে অবতরণ করেছে চাঙ ই ফোর। এই প্রথম কোনও দেশের চন্দ্রযান পৃথিবী থেকে সোজা গিয়ে নেমেছে চাঁদের বিপরীত পৃষ্ঠে।
চাঁদের এই উলটো দিকটি নিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামাচ্ছেন অনেক দিন ধরেই। অবশ্যই তার প্রধান কারণ হলো, ওই উলটো দিকটি কখনও পৃথিবীর মুখোমুখি হয় না। মহাজগতের প্রাকৃতিক নিয়মেই উভয়ের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ওই যে পৃথিবী আর চাঁদের ঘোরার নিয়ম আলাদা। পৃথিবীর আবর্তন চক্র বা সূর্যকে এক বার প্রদক্ষিণের সময় এবং ঘূর্ণন চক্র বা নিজের কেন্দ্রকে ঘিরে এক বার পাক খাওয়ার সময় আলাদা। কিন্তু চাঁদের আবর্তন চক্র এবং ঘূর্ণন চক্র একই। সেই কারণেই পৃথিবী থেকে সর্বদা চাঁদের এক দিককেই দেখা যায়। চাঁদের এক দিন মানে পৃথিবীর ১৪ দিন। চাঁদের এক রাতও পৃথিবীর ১৪ রাতের সমান। এ তো গেল পৃথিবী আর চাঁদের নিজস্ব কক্ষপথ ধরে ঘোরার ক্ষেত্রে পার্থক্যের কথা। পৃথিবীর তুলনায় চাঁদের দিন ও রাতের তাপমাত্রার ফারাকও বিরাট। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, দিনের বেলায় চাঁদে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা গিয়ে পৌঁছায় ১২৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। রাতে কমতে কমতে তা নেমে যায় মাইনাস ১৮৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। চাঙ ই ফোর এখন মাপবে যে, তাপমাত্রার এহেন দীর্ঘ বন্ধনীর মধ্যে হিমাঙ্ক কত। দিন ও রাতের তাপমাত্রার ফারাক ঠিক কতটা, তাও মেপে দেখবে এই চন্দ্রযান।
এটি চীনের দ্বিতীয় চন্দ্রাভিযান। এর আগে ২০১৩ সালে চীন পাঠিয়েছে চাঙ ই থ্রি। সেটিকে পাঠানো হয়েছিল পৃথিবীর দিক থেকে চাঁদের সোজা পিঠে। সেটিই চীনের প্রথম চন্দ্রযান। সিনহুয়ার তথ্য অনুসারে, গত ৫বছরে এটি চাঁদের হিসাবে ৬০ রাতেরও বেশি কাটিয়েছে চাঁদের মাটিতে। এখনও চাঙ ই থ্রি সক্রিয় রয়েছে। তবে চাঙ ই থ্রি তৈরি করা হয়েছিল বিদেশি বিজ্ঞানীদের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে। চাঙ ই ফোর সেখানে নিজেই সংগ্রহ করছে তথ্য। তা যেমন চীনের দেশিয় মহাকাশ গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তেমনই চীনে ভবিষ্যতের চন্দ্রযান নির্মাণের কাজেও লাগবে। চীনের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র জানিয়েছে, চাঙ ই ফোর চাঁদের রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় চলে যাবে চাঁদের মাটিতে। কারণ, সেটি সৌরশক্তি পাবে না। তখন এই চন্দ্রযানটি নিজেকে গরম রাখবে রেডিওআইসোটোপকে ব্যবহার করে। চীন ও রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা যৌথ উদ্যোগে তার ব্যবস্থা করেছেন। নিজেকে গরম রাখার সেই তাপকে কাজে লাগিয়ে শক্তি তৈরি করবে চাঙ ই ফোর। সেই শক্তির সাহায্যে চন্দ্রযানটি থার্মোমেট্রিকে চালু রাখবে, মাপবে রাতের বেলায় চাঁদের তাপমাত্রা। এখন পর্যন্ত চাঁদের ওই উলটো পিঠটি বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে অনেক কিছুই গোপন রেখেছে। তবে বিশ্বকবির ভাষায় বলাই যায়, গোপন কথাটি রবে না গোপনে , সৌজন্যে চাঙ ই ফোর।