কিংকর অধিকারী: সরকারের কাছে আগাম তথ্য থাকা সত্ত্বেও বাড়ি ফেরার সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণায় লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক, চিকিৎসার কারণে বাইরে যাওয়া সহ বিভিন্ন কারণে অসংখ্য সাধারণ মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আটকে রয়েছে। তাদের দুর্বিসহ যন্ত্রনাকে চাপা দিয়ে লকডাউনকে বাস্তবায়িত করা যাবে কি? লকডাউন ঘোষণার আগে কয়েকদিনের জন্য চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বাড়ি ফেরার সুযোগ দেওয়া গেল না কেন? তা না করার জন্য আজ গোটা দেশ জুড়ে যদি সেইসব মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাহলে এতদিনের প্রচেষ্টা কি করে সফল হবে? যাঁরা বিদেশ থেকে ভাইরাস আনলো তাঁদের প্রতি আমরা যতটা যত্নশীল থেকেছি, ততটাই উদাসীন থেকেছি এইসব মানুষদের ক্ষেত্রে যাঁরা প্রকৃতপক্ষে সভ্যতার পিলসুজ। দিল্লির পর মহারাষ্ট্রে ছড়িয়েছে বিক্ষোভ। তাদের দাবি, “হয় দু'বেলা খাওয়া থাকার ব্যবস্থা করে দাও, নইলে বাড়ি ফেরার একটা সুযোগ করে দাও।” প্রত্যুত্তরে পেয়েছে পুলিশের লাঠি। এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতির সময় আমরা ভীষণ ভাবে আতঙ্কিত!
মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের যাঁরা স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ পরিবার পরিজন নিয়ে নিশ্চিন্তে রয়েছেন তাঁদের অনেকেই বলে উঠবেন, এত বড় একটা সংকটের মুহূর্তে এইসব ভাবার দরকার নেই। তাঁদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনাদের দীর্ঘ অভ্যস্ত আরামের জীবনের বাইরে এসে দেখুন এরা কোন্ পরিস্থিতিতে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ''চিরকালই মানুষের সহায়তায় একদল অখ্যাত লোক থাকে, তাদেরই সংখ্যা বেশী, তারাই বাহন;তাদের মানুষ হবার সময় নেই, দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সবচেয়ে কম খেয়ে,কম পরে কমশিখে, বাকি সকলের পরিচর্যা করে,সকলের চেয়ে বেশী তাদের অসম্মান। কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপসে মরে,–জীবনযাত্রার জন্য যত কিছু সুযোগ সুবিধা সবকিছুরর থেকেই তারা বঞ্চিত। তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে; উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।”
এলাকার যারা ওই সব জায়গায় কাজকর্মের সূত্রে আটকে গিয়েছে তারা কেমন আছে জানতে চেয়েছিলাম। তাদের সেই যন্ত্রণার কথা তুলে ধরছি। বিভিন্ন রাজ্য থেকে যাওয়া এইসব হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ অসংগঠিত শ্রমিক বিভিন্ন মালিকের অধীনে কাজ করায় তারা অধিকাংশই স্থায়ীভাবে কোনো কোম্পানি বা মালিকের অধীনে কাজ করে না। এরা কেউ কাঠের কাজ, কেউবা রাজমিস্ত্রি, কেউ রং-এর কাজ, কেউ পাথরের কাজ ইত্যাদি অস্থায়ীভাবে কন্ট্রাকটারের অধীনে কাজ করে। কাজে না গেলে বেতন মেলেনা। নিজেদের সামান্য অর্থ দিয়ে কিছুদিন তারা চালিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আটকে থাকা আর্থিকভাবে চরম সংকটগ্রস্ত এই মানুষদের জন্য আজ পর্যন্ত সরকারিভাবে একটা দানাপানিও দেওয়া হয়নি বলে তাদের অভিযোগ। প্রথম দফার লকডাউন ঘোষণার পর তারা দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করছিল, নিশ্চয়ই ১৪ ই এপ্রিলের পর তাদের বাড়ী ফেরার একটা ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু নতুনভাবে লকডাউনের দিনক্ষণ বাড়িয়ে দেওয়া হলো (পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে), কিন্তু তাদের দু'বেলা খাওয়া ও থাকার কোন সংস্থান করা হলো না। ফলে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। জানতে পারলাম, বছরের এই সময়টা এইসব সামান্য আয়ের শ্রমিকরা তাদের পরিবারকে এক মাসের জন্য নিয়ে যায় নিজেদের কাছে। ওই অল্প সময়ের জন্য তারা আলাদা করে ছোট্ট একখানা করে বাড়ি ভাড়া নেয়। সামান্য টাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাড়ির বাবা মা অথবা ছেলে, মেয়ে, বউকে নিয়ে কিছু দিন কাটায়। তারপর সেই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে পুনরায় একসাথে অনেক শ্রমিক থাকার জায়গায় ফিরে যায়। আর বাড়ির লোকজন বাড়ি ফিরে যায়। এটা প্রতি বছরের সাধারণ ঘটনা। কিন্তু হঠাৎ এই ভাবে সমস্ত কিছু অচল হয়ে যাওয়ায় বউ, বাচ্চা পরিবার নিয়ে এখন তারা প্রায় অনাহারে এবং চরম সঙ্কটে!
শুধু পরিযায়ী শ্রমিক নয়, দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য আটকে রয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। যাঁরা চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল আজ তাঁরাও ঘর ভাড়া নিয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন। রোগী নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছে না।
কিছু রোজগারের আশায় যেসব পরিযায়ী শ্রমিকরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে তাদের কাছ থেকে যখন খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, তাদের সেই অব্যর্থ যন্ত্রণার কথা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা ছোট্ট একটি ঘরে আট দশজন করে ভাড়া নিয়ে থাকে। সকাল হলে কাজে বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যেবেলা ফিরে নিজেরা রান্নাবান্না করে খায়। ওই ছোট্ট ঘরের মধ্যেই সবকিছুই করতে হয়। রান্নাবান্না খাওয়া-দাওয়ার পর জিনিসপত্র সরিয়ে দিয়ে ঘর মুছে সেখানেই তারা ঠাসাঠাসি ভাবে শুয়ে পড়ে। এটাই তাদের জীবন। হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণার ফলে তারা সবাই আজ কাজ হারিয়ে গৃহবন্দি। অল্প ওইটুকু জায়গায় গাদাগাদি অবস্থায় দিনের পর দিন ঠায় বসে এবং ঘুমিয়ে কাটাতে হচ্ছে। রুমের বাইরে বেরোনো যাচ্ছেনা। প্রচন্ড গরমে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিনের পর দিন আটকে থাকায় অসহ্য হয়ে উঠেছে বাড়ির ভেতরের পরিবেশ। কোন কোন জায়গায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ কেউ মাঝেমধ্যে চালডাল দিয়ে গেলে তাতে চলছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। সরকারিভাবে তাদের কাছ থেকে আধার কার্ড নম্বর সহ বিভিন্ন তথ্য চেয়ে নিয়ে গেলেও সরকারি কোনো অনুদান আজ পর্যন্ত পৌঁছায়নি তাদের কাছে। এই ব্যবস্থা টুকু যদি করা যেত তাহলে মানুষ গুলো অন্তত দুবেলা দুমুঠো খেয়ে দিন গুজরান করতে পারত। তাদের হাতে যেসব সামান্য টাকা পয়সা ছিল তা প্রায় নিঃশেষ। এখন ভবিষ্যৎটা তাদের কাছে ক্রমশ কালো হয়ে আসছে। কোনটাই আমার ব্যক্তিগত ধারণার কথা নয়, ওখানে থাকা মানুষদের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু জানতে পেরেছি সেটাই তুলে ধরলাম।
এই মানুষগুলোর জন্য যদি সেই সেই রাজ্যের সরকার থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করতো তাহলে মানুষ আজ এই সংকটের সম্মুখীন হত না। তাদের আকুতি– “এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভাইরাসের আক্রমণে যত না মানুষ মারা যাচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ অনাহারে মারা যাবে।”
১৪ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে দেশের মানুষের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, এই সময়টা যতটা পারেন গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ান। দেশের মানুষ যথা সম্ভব গরিব মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছে। আমরা সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে বিভিন্ন রাজ্যের এবং কেন্দ্রের মানবিক সরকারের কাছে আবেদন করছি, এদের কথা একটু ভাবুন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “সমাজের উপরের থাকের লোক খেয়ে পড়ে পরিপুষ্ট থাকবে আর নিচের থাকের লোক অর্ধাশনে বা অনশনে বাঁচে কি মরে সে সম্বন্ধে সমাজ থাকবে অচেতন এটাকে বলা যায় অর্ধাঙ্গের পক্ষাঘাত।” এদেরকে বাঁচান। এরাই সভ্যতার ভিত। এদেরকে অস্বীকার করে কোনো সভ্য সমাজ এগোতে পারে না।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)