তাঁর দল কংগ্রেস থেকেও বহিস্কার হতে হয়েছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়কে

তাঁর দল কংগ্রেস থেকেও বহিস্কার হতে হয়েছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়কে

তপন মল্লিক চৌধুরী:  ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পরও  প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি প্রণব মুখোপাধায়। আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড ‘টারবুলেন্ট ইয়ার্স :১৯৮০-১৯৯৬’-এ তিনি লিখেছেন, দলের কিছু মতলববাজ লোক তাঁর সম্পর্কে এমন ভুল তথ্য রটিয়েছিল যাতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনও ইচ্ছাই আর তাঁর ছিল না।

১৯৬৯ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাহায্যে ভারতীয় সংসদের রাজ্যসভায় কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। আর তারপর থেকেই রাজনৈতিক কর্মজীবনে তাঁর উত্থান হয় অতি দ্রুত। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর একজন বিশ্বস্ত সহকর্মীতে পরিণত হন। এরপর ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনেট মন্ত্রিসভায় জায়গা পান তিনি। কিন্তু ইন্দিরা হত্যার পরেই একটি দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব্ব্বের শিকার হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। রাজীব গান্ধী তাঁকে নিজের ক্যাবিনেটে জায়গা দেননি। কিছুদিনের জন্য তাঁকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। এই সময় তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে নিজস্ব একটি দলও গঠন করেছিলেন। তবে ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার পর এই দল নিয়ে তিনি আবার কংগ্রেসে যোগ দেন।

ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর প্রণব মুখোপাধায় সম্পর্কে বিভিন্ন মহলে প্রচার ছিল,  তিনি রাজীব গান্ধীর পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন।  ইন্দিরা গান্ধীকে যেদিন হত্যা করা হয়, সেদিন রাজীব গান্ধী দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সফরে ছিলেন। সেদিন তার দিল্লিতে ফেরার কথা ছিল। বিমানের ককপিঠে উঠেই ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার খবর পান রাজীব। প্রণব মুখোপাধায় লিখেছেন, দায়িত্ব পালন করার সময় প্রধানমন্ত্রীর স্বাভাবিক মৃত্যু হলে সাধারণত দলের দ্বিতীয় ব্যক্তিই তার স্থলাভিষিক্ত হন। এখানে ঘটনা ছিল অন্য। দলের একাংশ হঠাৎ রটিয়ে দেয়, তিনি নিজেই নাকি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন।

ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি স্বীকার করেছেন, রাজনৈতিক জীবনে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হওয়া তাঁর অন্যতম বড় ধাক্কা ছিল। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে মনোমালিন্যের কারণে দল থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। রাজীব গাঁধীর সঙ্গে ব্যক্তিগত তিক্ততা না থাকলেও রাজীব-ঘনিষ্ঠ মাখনলাল ফতেদার এবং অরুণ নেহরুর খবরদারি মানতে পারেননি প্রণব। সেই ঘটনা সম্পর্কে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় প্রণববাবু একাধিক বার জানিয়েছেন, তখন বয়স অল্প ছিল। রাজনৈতিক বিচক্ষণতা সে ভাবে ছিল না। তাই ধৈর্যচ্যুতি হয়েছিল।

এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখন নরসিংহ রাও দায়িত্ব নেন। সেদিন রাতে নরসিংহের ৯ মোতিলাল নেহরু রোডের বাড়িতে গেলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। মন্ত্রিসভায় ‘যোগ্য মন্ত্রী’ কারা হতে পারেন, তার একটি সম্ভাব্য তালিকা দিলেন নতুন প্রধানমন্ত্রীকে। সেই তালিকার সুপারিশ মেনেও নিয়েছিলেন নরসিংহ। কিন্তু কোনও ফোন পাননি প্রণব।

তাঁকে অর্থমন্ত্রী করা হবে, এই আশায় বুক বাঁধলেও শেষ পর্যন্ত বাণিজ্য এবং শেষে বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্বও পান তিনি। উল্টে সকলকে চমকে দিয়ে অর্থমন্ত্রী করা হয় মনমোহন সিংহকে। মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়লেও সে দিন মুখ খোলেননি প্রণব। অসীম ধৈর্য দেখিয়ে চুপ করে যান। দীর্ঘ কয়েক মাস পরে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদের দায়িত্বে পান প্রণব। রাওয়ের মন্ত্রিসভায় পরে তিনি ক্যাবিনেট মন্ত্রীরূপেও যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে তিনি রাওয়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

সনিয়া গান্ধীর জমানায় তাঁকে ইউপিএ-র প্রধানমন্ত্রী করা হবে বলে জল্পনা চললেও শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পান মনমোহন। খাতায়-কলমে মনমোহন প্রধানমন্ত্রী হলেও বকলমে ইউপিএ-সরকার চালানোর অনেকটা কৃতিত্বই কিন্তু প্রণববাবুর। অসুস্থ হয়ে মনমোহন একবার প্রণববাবুকে ফোন করে বলেন, ‘স্যার, আমার অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হয়েছে। আপনাকেই কিন্তু দেশ চালাতে হবে।’ এবং তা-ই হয়েছে। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী সশরীরে উপস্থিত থাকলেও বর্তমান মন্ত্রিসভা পরিচালনা করেছেন প্রণববাবু। এক সময়ে প্রায় পঞ্চাশটি মন্ত্রিগোষ্ঠীর নেতৃত্ব পর্যন্ত দিয়েছেন তিনি। মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিজের মন্ত্রকের পাশাপাশি অন্য মন্ত্রকের ফাইলও আগাগোড়া ‘স্টাডি’ করে আসতে দেখা যায় তাঁকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × one =