অন্তর্ঘাত হবে? কলকাতা উত্তরে শুধুই এই ফিসফাস! উত্তর মেলাবে কে? বিশেষ প্রতিবেদন

নিজস্ব প্রতিনিধি: কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে কী হবে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত রাজনৈতিক মহল। লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ৪২টি কেন্দ্রের মধ্যে যেগুলি নিয়ে রাজনীতি সচেতন…

North Kolkata Sudip Bandyopadhyay

নিজস্ব প্রতিনিধি: কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে কী হবে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত রাজনৈতিক মহল। লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ৪২টি কেন্দ্রের মধ্যে যেগুলি নিয়ে রাজনীতি সচেতন মানুষের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হল কলকাতা উত্তর কেন্দ্র। এখানে তৃণমূলের হেভিওয়েট প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে রয়েছেন বিজেপির তাপস রায় এবং বাম সমর্থিত কংগ্রেসের জোট প্রার্থী প্রদীপ ভট্টাচার্য। তবে মূল লড়াইটা যে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যেই হচ্ছে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এই পরিস্থিতিতে কলকাতা উত্তর কেন্দ্রে যে রাজনৈতিক গোলকধাঁধা তৈরি হয়েছে, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে সব মহল। সেই চেষ্টা করেছে ‘আজ বিকেল’ও। আর সেখানে একটা শব্দই বারবার শোনা গিয়েছে যুযুধান দু’পক্ষের পাশাপাশি একাধিক ভোটারের মুখে। সেই শব্দটি হল ‘অন্তর্ঘাত’। কারণ ‘যুব তৃণমূল’ ও ‘মাদার তৃণমূল’-এর মধ্যে যে অলিখিত লড়াই রয়েছে রাজ্যের নানা প্রান্তে, সেটা এই কেন্দ্রে বড্ড বেশি প্রকট বলে অনেকেই মনে করছেন। সেই সূত্রেই বারবার ঘুরে ফিরে আসছে অন্তর্ঘাত তত্ত্ব।

গত লোকসভা নির্বাচনে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ভোট পেয়ে ১ লক্ষ ২৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিনহাকে হারিয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। সুদীপ পেয়েছিলেন ৪ লক্ষ ৭৪ হাজার ৮৯১ ভোট। সেখানে রাহুল পেয়েছিলেন ৩ লক্ষ ৪৭ হাজার ৭৯৬ ভোট। পেয়েছিলেন সাড়ে ৩৬ শতাংশ ভোট।

অন্যদিকে সিপিএম এবং কংগ্রেস আলাদা লড়েছিল। তাদের ভোট যোগ করলে সেটি হয় ৯৭ হাজার। যা কিনা মোট প্রদত্ত ভোটের ১০ শতাংশ। সেই জায়গা থেকে তো নিজের জয় নিয়ে সুদীপের সামান্যতম চিন্তা থাকা উচিত নয়। কিন্তু তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়ে ‘খেলা’ ঘুরিয়ে দিয়েছেন বহু যুদ্ধের নায়ক তাপস রায়। সেই সঙ্গে রয়েছে তৃণমূলের প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। আর সেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্যেই কলকাতা উত্তরে সুদীপের পক্ষে উত্তরটা নিশ্চিতভাবে মিলবে কিনা তা নিয়ে বড় প্রশ্ন চিহ্ন দেখা দিয়েছে।

কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে ৬০টি ওয়ার্ড রয়েছে। কলকাতা পুরসভার গত নির্বাচনে সেখানে মাত্র তিনটিতে জয় পেয়েছে বিজেপি। একটিতে জয় পেয়েছিল কংগ্রেস। বাকি সবকটিতেই জোড়া ফুলের ঝড় চলেছে। এই লোকসভার অন্তর্গত প্রত্যেকটি বিধানসভায় তৃণমূলের বিধায়ক রয়েছেন। শুধুমাত্র মানিকতলা কেন্দ্রের তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক সাধন পাণ্ডের মৃত্যুর পর আইনি জটিলতার কারণে এখানে উপনির্বাচন হয়নি। অর্থাৎ যাবতীয় পরিসংখ্যান বলছে তৃণমূলের জয় নিয়ে কোনও সংশয় থাকার জায়গা নেই। কিন্তু এই কেন্দ্রের মানুষের মুখে একটু অন্য কথা শোনা যাচ্ছে। সেখানে যেন গন্ধটা এবার অন্যরকম মনে হচ্ছে।

কলকাতা উত্তরে (অতীতে এটি ‘উত্তর কলকাতা’ লোকসভা কেন্দ্র নামে পরিচিত ছিল) চার দশকের ভোটের ফলাফল বলছে ২০০৪ সাল বাদে এখানে কংগ্রেস বা তৃণমূল জিতেছে। ২০০৪ সালে সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিমের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন অজিত পাঁজা। যদিও ডিলিমিটেশনের পর ২০০৯ সালে নতুন করে এই কেন্দ্রটি গড়ে ওঠে এবং নাম হয় কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্র। সেই বছর বিলুপ্ত হয় উত্তর পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্র। অর্থাৎ একটা সময়ে কলকাতায় তিনটি লোকসভা কেন্দ্র থাকলেও ২০০৯ থেকে রয়েছে কলকাতা উত্তর এবং কলকাতা দক্ষিণ কেন্দ্র। সেই ২০০৯ সাল থেকে কলকাতা উত্তর কেন্দ্রে টানা জিতে আসছেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এবার? প্রশ্নটা সেখানেই।

এ প্রসঙ্গে কলকাতা পুরসভার ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত রাজাবাজার মোমিন হাইস্কুলের সামনে এক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তি এই প্রতিবেদককে বলেন,

“আমাদের সিংহভাগ ভোট তৃণমূল পাবে। কিছু ভোট যাবে কংগ্রেসের দিকে। কিন্তু একটা কথা বলতেই হচ্ছে বিজেপি প্রার্থী তাপস রায় কিন্তু অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। তাঁর সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের যথেষ্ট ভাল যোগাযোগ দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। এখন হয়ত তিনি বিজেপিতে যাওয়ায় আমাদের ভোট পাবেন না। তবে মনে রাখবেন আমরা বিজেপির বিরুদ্ধে, তাপসবাবুর বিরুদ্ধে নই।”

অর্থাৎ তাপস সম্পর্কে বিরূপ ধারণা নেই তাঁর।

এরপরই চারপাশ দেখে তাঁর ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য,

“একটা কথা শুনছি এবার নাকি তৃণমূলের বাঁধা ভোটের পুরোটা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে নাও আসতে পারে। চলে যেতে পারে অন্যদিকে।”

অন্যদিকে বলতে কী আপনি বিজেপিকে বোঝাচ্ছেন? উত্তর এল, সেটা বুঝে নিন। এর বেশি তিনি আর কিছু বলতে চাইলেন না। তবে ইঙ্গিতে বোঝা গেল তৃণমূলের যে বাঁধা হিন্দু ভোট রয়েছে, তার পুরোটা এবার সুদীপের দিকে আসবে না। আর সেই বিষয়টি স্পষ্ট করে দিলেন এই লোকসভার অন্তর্গত ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এক বৃদ্ধা। নাম প্রকাশ করা যাবে না এই শর্তে তিনি বলেন,

“চারদিকে শুধু চুরি আর চুরি। ১৯৯৮ সাল থেকে আমরা তৃণমূলকে ভোট দিয়ে আসছি। এবার কিন্তু ভোটটা বিজেপিকে দেব।”

অন্যদিকে এই লোকসভার অন্তর্গত ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন,

“আমরা ট্র্যাডিশনাল কংগ্রেসের ভোটার। বিগত কয়েকটি পুরসভা নির্বাচনে এই ওয়ার্ডের বড় অংশের মানুষ কংগ্রেসের সন্তোষ পাঠককে ভোট দিয়ে জিতিয়েছেন। কিন্তু সেই ভোটের সিংহভাগ এবার চলে যাবে বিজেপি প্রার্থীর ঝুলিতে। কারণ আমরা তৃণমূলকে হারাতে চাই।”

এ তো গেল সাধারণ ভোটারদের কথা। একাধিক তৃণমূল পার্টি অফিসে থাকা স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গিয়েছে, সুদীপের জয় নিয়ে তাঁরা যথেষ্ট আশাবাদী হলেও অতীতের মতো কিন্তু একশো শতাংশ নিশ্চিত হন এবার। তার কারণ অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনা তাঁরা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। একটি পার্টি অফিসের বাইরে গিয়ে তৃণমূলের এক সক্রিয় কর্মী বললেন,

“সুদীপদার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল আমাদের দলের অন্যতম নেতা কুণাল ঘোষের। এখন ওপরে ওপরে তা মিটে গিয়েছে দেখা গেলেও ভেতরে চোরাস্রোত যে বইছে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে?”

এখানেই শেষ নয়, এই লোকসভার অন্তর্গত তৃণমূলের এক কাউন্সিলরের নাম করে দলের আরও এক সক্রিয় কর্মী বললেন,

“৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর মোনালিসা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর অনুগামীরা কী করবেন সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন আমরা। অবশ্যই অন্তর্ঘাত হতে পারে সেখানে। এই ওয়ার্ড থেকে সুদীপদার লিড পাওয়া কার্যত অসম্ভব।”

মধ্য কলকাতার ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের এই কাউন্সিলর অভিযোগ করে বলেছিলেন প্রচারে তাঁকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। পরে সুদীপের উপস্থিতিতে ‘মিটমাট’ হয়ে যায়। কিন্তু সেটাও যে ওপরে ওপরে, তা তো সকলেরই জানা। এমনটাই বলতে চাইলেন তৃণমূলের ওই কর্মী। যদিও ভিন্ন মতও রয়েছে। তৃণমূলের বহু নেতা কর্মী বলছেন,

“এটা লোকসভা নির্বাচন। মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে ভোট দেবেন। আর এটাই সম্ভবত সুদীপদার শেষ নির্বাচনী লড়াই। বয়সের কারণে আগামী লোকসভা নির্বাচনে তিনি হয়ত আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। তাই বিপুল ভোটেই তিনি জিতবেন, এমনটাই আশা আমাদের।”

যদিও তৃণমূলের এই দাবি উড়িয়ে দিচ্ছে বিজেপি। বিজেপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গিয়েছে তার নির্যাস এটাই যে, গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। তাই এবার ৭ শতাংশ ভোট বিজেপির দিকে সুইং হলেই কেল্লাফতে। সেক্ষেত্রে তৃণমূলের থেকে ৫-৬ শতাংশ, আর জোট প্রার্থীর থেকে ২-৩ শতাংশ ভোট বিজেপির দিকে এলেই তো ‘খেলা’ ঘুরে যাবে। এমনটাই বলছেন তাঁরা। আর সেটা নিয়ে বিজেপি এবার নিশ্চিত।

সবচেয়ে বড় কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কলকাতা উত্তর কেন্দ্রে রোড শো করবেন। তাতেই যথেষ্ট ভোট সুইং বিজেপির পক্ষে হবে বলে দলের দাবি। তবে সবচেয়ে বড় কথা জেতার জন্য তৃণমূলের অন্তর্ঘাতের দিকেই মূলত তাকিয়ে রয়েছে বিজেপি। কারণ কলকাতা উত্তর কেন্দ্রে বিজেপির সেই পর্যায়ের সংগঠন এখনও তৈরি হয়নি। সবমিলিয়ে কলকাতা উত্তর কেন্দ্রে ‘অন্তর্ঘাত ইস্যু’ যে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে দিতে সাহায্য করবে, সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই।

লোকসভা ভোটের সব খবর জানতে নজর রাখুন

Politics- Political Sabotage: Political circles are abuzz with whispers of possible sabotage in the North Kolkata elections. The constituency, known for its high political stakes, sees a fierce battle between TMC’s heavyweight Sudip Bandyopadhyay and BJP’s Tapas Ray.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *