অটলের বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ নেহেরু বলেছিলেন, দেশের ‘ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’

অটলের বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ নেহেরু বলেছিলেন, দেশের ‘ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’

তপন মল্লিক চৌধুরী: ১৯৫৭ সালে তরুণ সংসদ সদস্য অটলবিহারী বাজপেয়ীর বক্তৃতা শুনে দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে পেয়েছিলেন দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। শুধু তাঁর তাঁর বক্তৃতা শুনেই নেহরু বলেছিলেন, তুমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবে। এর ৩৮ বছর পর বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তিনি।

জনসঙ্ঘ থেকে বিজেপি, জনতা সরকারের বিদেশমন্ত্রী থেকে দেশে  প্রথম অকংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী তিনি। দুর্ভাগ্যবশত ১৯৯৬ সালের সেই সরকারের পতন হয় ১৩ দিনে। এরপর ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সেই সরকারেরও পতন হয়েছিল ১৯ মাসে।  রাজনৈতিক জীবন শুরু আর্য সমাজে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অটল বাবাসাহেব আপ্টের হাত ধরে তরুণ অটলবিহারী পূর্ণসময়ের কর্মী হিসেবে যোগ দেন আরএসএসে। তার মধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর হন অটলবিহারী।

দীনদয়াল উপাধ্যায়ের রাষ্ট্রধর্ম পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। একই সঙ্গে লেখালিখি চলতে থাকে পাঞ্চজন্য-সহ অন্য পত্রিকাগুলিতেও। ১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারি নাথুরাম গডসের হাতে গান্ধীর হত্যার পর দেশ জুড়ে নিষিদ্ধ হয় আরএসএস। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জনসঙ্ঘে যোগ দেন বাজপেয়ী। ১৯৫৪ তে কাশ্মীরে শ্যামাপ্রসাদের কাশ্মীর যাত্রার আগে তাঁর সঙ্গে ছিলেন দুই তরুণ অটলবিহারী বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আডবাণী।

বাবা স্কুল শিক্ষক কৃষ্ণবিহারীও কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই ছন্দের অনুরাগ পেয়েছিলেন অটল। বাবা আর ছেলে একই সঙ্গে আইন পড়েছেন একই বর্ষের ছাত্র হিসাবে, থাকতেনও একই হস্টেলে। দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর জনসঙ্ঘের দায়িত্ব পান অটল। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু লালকৃষ্ণ আডবাণী। কবিতা প্রেমী, পুস্তক প্রেমী অটল দিল্লির রিগ্যাল সিনেমা হলে বহু নতুন সিনেমার প্রথম দিনের প্রথম শো দেখতে যেতেন। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে অন্য বিরোধী নেতাদের সঙ্গে গ্রেফতার হন বাজপেয়ী।

জয়প্রকাশ নারায়ণের ডাকে সাড়া দিয়ে কংগ্রেস বিরোধী জনতা দলে যোগ দেয় জনসঙ্ঘ। ৭৭-এর ভোটে ক্ষমতায় আসে জনতা দল। মোরারজি দেশাইয়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রী হন বাজপেয়ী। সেই সরকার বেশিদিন চলেনি। এরপর জনসঙ্ঘ থেকে তৈরি হল নতুন দল ভারতীয় জনতা পার্টি। জনতা সরকারের পতনের পর বাজপেয়ী-আডবাণী জুটির উদ্যোগেই জন্ম নেয় নতুন এই দল। সাফল্য খুব তাড়াতাড়ি আসেনি। প্রথমবার মাত্র দু’টি আসন জেতে বিজেপি। ভিত শক্ত হয় অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ আন্দোলনে ভর করে। বাজপেয়ীকে মুখ করে ১৯৯৬-এর ভোট লড়ে পদ্ম শিবির। ইউনাটেড ফ্রন্ট সরকারও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৮ সালে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক দল নিয়ে এনডিএ জোট তৈরি করে বিজেপি।

১৯৯৮ সালের মে মাসে পোখরানে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করে ভারত। পাকিস্তানের সঙ্গে মৈত্রী বাড়াতে দিল্লি-লাহোর বাসযাত্রাও শুরু করেন বাজপেয়ী। ১৯৯৯-এর মে মাসে হঠাৎ জোট ছেড়ে দেন জয়ললিতা। ১৩ মাসের মাথায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় বাজপেয়ী সরকার। অন্যদিকে কাশ্মীর সীমান্তে অনুপ্রবেশ। শুরু হয়ে যায় কার্গিলের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ জয়ের পর বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসে এনডিএ।

পাঁচ বছরে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা, সর্বশিক্ষা মিশন, সোনালি চতুর্ভুজ প্রকল্পের কৃতিত্ব বাজপেয়ীর। পাশাপাশি তেহলকা দুর্নীতি, গুজরাট হিংসার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ২০০৪ সালে বাজপেয়ীর শাইনিং ইন্ডিয়াকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসে ইউপিএ সরকার। শেষ হয় অটলযুগের। আর ফেরেননি বাজপেয়ী।

অটলবিহারী বাজপেয়ী সংসদের দু’কক্ষে মোট ১২ বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজ্যসভায় দু’বার এবং লোকসভায় ১০ বার। কিন্তু এর বাইরেও তাঁর দখলে রয়েছে এমন এক নজিরবিহীন রেকর্ড, যা ভারতের আর কোনও রাজনীতিকের নেই। ১৯৫৭ সালে প্রথমবার সাংসদ হিসাবে নির্বাচিত হওয়া থেকে সব মিলিয়ে ১২ বার, তিনিই এক মাত্র সাংসদ যিনি সংসদে দেশের ৪টি রাজ্য থেকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত এবং দিল্লি মিলিয়ে ৪টি রাজ্য। শুধু ভারত নয়, গোটা পৃথিবীর রাজনীতিতে এটি বিরল কৃতিত্ব বলেই ধারণা করা যেতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eighteen + seventeen =