দেবময় ঘোষ: কেন্দ্রীয় বিজেপিতে মুকুল রায়ের উচ্চ পদ, তার ঘনিষ্ঠ অনুপম হাজরা রাহুল সিনহাকে সরিয়ে জাতীয় সম্পাদক পদে মনোনীত হওয়া বিভিন্ন দিক থেকেই ইঙ্গিতবাহী। কেন্দ্রীয় বিজেপি এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পরিষ্কার করে দিয়েছে, নির্বাচনে জেতার সেনাপতি মুকুল রায়। তবে এটাও ঠিক, বিজেপির সংগঠন অনুযায়ী জাতীয় সহ সভাপতির পদগুলি মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু, প্রবল সাংগঠনিক ক্ষমতা নেই। সেদিক থেকে, মুকুল যে কেন্দ্রীয় স্তরে খুব বড় দায়িত্ব পেয়েছেন – এমন ভাবার কারণ নেই।
মুকুলের পদোন্নতি: দীর্ঘদিন ধরেই বিজেপিতে একটি পদ চাইছিলেন মুকুল রায়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে বিজেপিতে এসে ‘পদহীন নেতা’ হিসেবে নিজের ‘পারফরম্যান্স’ দেখিয়ে চলেছিলেন মুকুল। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ২ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে নেয় বিজেপি। ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন দখল করে পদ্ম শিবির। রাজ্য বিধানসভায় বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা বাড়ে। তৃণমূল, বাম এবং কংগ্রেস ছেড়ে নেতারা বিজেপিতে যোগ দেয়। সেই ২০১৭ নভেম্বর থেকে এরাজ্যে ধারে-ভারে অনেকটাই বড় হয়েছে বিজেপি। পুরস্কার স্বরূপ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে কিছু প্রাপ্য ছিল মুকুলের। জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে জায়গা হয়েছিল মুকুলের। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের যাবতীয় দায়িত্বে ছিলেন। এবার, মন্ত্রী সভায় মন্ত্রিত্ব বা রাজ্যসভার সাংসদ নয়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাকে সংগঠনের কাজের সঙ্গে যুক্ত রাখলেন। বিজেপির সংগঠন অনুযায়ী জাতীয় সহ সভাপতির পদগুলি মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু, প্রবল সাংগঠনিক ক্ষমতা নেই। বরং, অনেক বেশি ক্ষমতাশালী জাতীয় সাধারণ সম্পাদক পদ।
একথা বুঝতে বেশি দেরি হওয়ার কথা নয় যে মুকুল জাতীয় সাধারণ সম্পাদক পদ পেতেন না। কারণ, বিজেপিতে মুকুল যাকে অনুসরণ করেন, সেই কৈলাস বিজয়বর্গীয় নিজে একজন জাতীয় সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মুকুলের জেদ মানতে বাধ্য হয়েছে। পার্টিতে পদ পাওয়ার প্রশ্নে লাগাতার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে চাপে রেখেছিলেন মুকুল। অনেকে তো এও বলেন, তিনি দল থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন। যাই হোক, মুকল রায়ের জাতীয় সহ সভাপতি পদ পাওয়া এবং তার ঘনিষ্ঠ নেতা অনুপম হাজরার জাতীয় সভাপতি হওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, ২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয় লাভ করার জন্য জগৎ প্রকাশ নাড্ডার নেতৃত্বাধীন বিজেপি রাজ্যে মুকুল রায়কেই সারথী করতে চাইছে।
রাহুল সিনহার গোঁসা: দীর্ঘদিন রাজ্য থেকে বিজেপির জাতীয় সম্পাদক ছিলেন রাহুল সিনহা। একমাত্র। বিজেপির প্রাক্তন এই রাজ্য সম্পাদককে সরিয়ে মুকুল ঘনিষ্ঠ অনুপম হাজরাকে ওই পদ দিয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সুতরাং, রাহুলের গোঁসা স্বাভাবিক। বিজেপির পুরান নেতাদের মধ্যে একজন রাহুল। ৪০ বছর তিনি বিজেপি করছেন। শনিবার প্রকাশ্যেই বলেছেন, তৃণমূল থেকে আসা নেতাদের জায়গা দিতেই এই কাজ করা হয়েছে। ১০-১২ দিনের মধ্যে তিনি যা করার করবেন। রাহুল দল ছাড়বেন কিনা বলেন নি। ছাড়লেও কোথায় যাবেন তা স্পষ্ট নয়। তৃণমূল থেকে আসা নেতাদের জায়গা করে দিতেই যখন তাকে পদ থেকে সরানো হল, তখন তিনি যে তৃণমূলের কথা ভাবছেন না তা পরিষ্কার। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল, এতদিন রাহুলের পারফরম্যান্স কী? তিনি নির্বাচনেও সফল নন। রাজ্য থেকে একজন যুবক, উদ্যমী জাতীয় সম্পাদক দরকার তা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন মুকুল।
দিলীপ শিবিরকে স্পষ্ট বার্তা: মুকুল রায়কে এতটা গুরুত্ব দিয়ে দিলীপ শিবিরকেও স্পষ্ট বার্তা দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। মুকুল রায় এবং দিলীপ ঘোষের ‘অম্ল-মধুর’ সম্পর্ক রাজ্য রাজনীতির অন্যতম চর্চিত বিষয়, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ পদাধিকার বলে সংগঠনের মাথায়। আবার দিল্লির পার্টি ভোট করানোর ব্যাপারে মুকুল রায়ের উপর বেশি নির্ভরশীল। বিজেপির সাম্প্রতিক সাফল্যের পিছনে মুকুলের অবদান স্বীকার করে গিয়েছেন অমিত শাহ, জে পি নাড্ডা। ভোটে জিততে যে মুকুলকে লাগবেই তা জলের মত পরিষ্কার বুঝেছে কেন্দ্রীয় বিজেপি। মুকুল কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি মনোনীত হওয়ার পর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়। যিনি দিলীপ ঘোষের খুব ঘনিষ্ট বলে কখনোই পরিচিত ছিলেন না।