নয়াদিল্লি: যোগী আদিত্যনাথ, শিবনাথ সিং চৌহান, বি এস ইয়েদুরাপ্পা কিংবা নীতিশ কুমারের করোনা নীতি আজ সারা ভারতে খুব আলোচনায় নেই। বরং, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের করোনা নীতি নিয়েই আলোচনা চলছে সবদিকে। কিন্তু, একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, নিজেদের রাজ্যে করোনা নিয়ে এদের কাজকর্ম কড়া সমালোচনার জায়গা তৈরি করে। এটা ঠিক, পশ্চিমবঙ্গে মৃত্যুর হার বেশি। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ৯ কোটি, উত্তরপ্রদেশের ২৩ কোটি। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক এবং জেডিএউ এর সঙ্গে বিজেপি শাসিত বিহারেড হালও আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে।
নিজের অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে ব্যস্ত ছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। পিতার মৃত্যুর খবর পান। কিন্তু, লকডাউন ভেঙে শেষকৃত্যে যেতে চাননি তিনি। তিনি ওই অনুষ্ঠানে গেলে লকডাউন ভাঙতই। উত্তরপ্রদেশের ২৩ কোটি জনতার সুরক্ষার দিকে তাকিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মা এবং নিকটাত্মীয়দের পিতার অন্তিমকাজ করতে বলেন। লকডাউন উঠে গেলেই তিনি সেখানে যাবেন, তাও জানান। সারা দেশ যোগী আদিত্যনাথের দায়িত্ববোধকে কুর্নিশ করেছে। তবে, মুদ্রার অন্যপীঠ অন্য গল্প বলে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের ওয়েবসাইট অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশে মোট করোনা পজিটিভ রুগীর সংখ্যা ৩০৭১ জন। সেরে উঠেছেন ১২৫০ জন। মৃত্যু হয়েছে ৬২ জনের।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ'কে উদ্ধৃত করে ৪ মে ইকনোমিক টাইমস লিখেছে, উত্তরপ্রদেশের 'টেস্ট পার মিলিয়ন' বা টিপিএম অর্থাৎ প্রতি ১০ লক্ষে করোনা পরীক্ষার সংখ্যা হল ৪২৯, যা ২৩ কোটি জনসংখ্যার রাজ্যে অত্যন্ত কম। এখানেই যোগীর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 'আগ্রা মডেলে'র কথা আর কেউ উচ্চারণ করছেন না। কারণ, উত্তরপ্রদেশের কোভিড আক্রান্ত জেলাগুলির মধ্যে উপরের দিকেই আছে আগ্রা। যোগীর উত্তরপ্রদেশে এর পর যা ঘটেছে, তা অবশ্য অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন। কোনও বড় ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রঙে প্রলেপ দিতে তাঁর সরকার বেশি দেরি করে না। এক্ষেত্রে, লক্ষ্ণৌ শহরের ১৮টি 'হটস্পট' এলাকার মধ্যে ৮টি'র সঙ্গে স্থানীয় মসজিদের নাম জুড়ে দেওয়া হল। যেমন শহরের সদর বাজার এলাকায় হটস্পট রয়েছে। যোগীর প্রশাসন তাঁর নামকরণ করেছে 'মসজিদ আলী জান এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল'।
বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশের অবস্থা উত্তরপ্রদেশের থেকে অল্প ভাল। শিবরাজ সিং চৌহানের রাজ্যে সাম্প্রতিক টিপিএম ৬৪২ (৪ মে ইকনোমিক টাইমস-এর রিপোর্ট)। কিন্তু, সংক্রমণ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। অনেকেই রাজ্যে শাসক দলের ক্ষমতার অপব্যবহারকে দায়ী করেন। মার্চের ২০ তারিখ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথ ক্ষমতাচ্যুত হন। একই দিনে, জব্বলপুরে ৪ ব্যক্তির শরীরে কোভিড-19 পাওয়া যায়। শিবরাজ খুব তাড়াতাড়ি লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু, যা ঘটে যাচ্ছে, তা আটকাতে পারেননি। ২০ মার্চ আরও একটি কাণ্ড ঘটে। বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথের বাড়িতে সাংবাদিক সম্মেলনে হাসির ছিলেন প্রায় ১০০ সাংবাদিক এবং চিত্র সাংবাদিক। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন কমলনাথ এবং মন্ত্রীরা। ওই ভিড়ে ছিলেন ৬২ বছরের এক করোনা আক্রান্ত সাংবাদিক। তিনি উপসর্গ বিহীন, তাই বুঝতে পারেননি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লন্ডন থেকে তাঁর মেয়ে বাড়িতে এসেছিলেন। সংক্রমণ ছড়িয়েছিল সেখান থেকেই।
মন্ত্রকের তথ্য বলছে বিজেপি শাসিত গুজরাটে ৭৪০২ টি সংক্রমণ ধরা পড়েছে। মৃত ৪৪৯ জন। সেরে উঠেছেন ১৮৭২ জন। কিন্তু, আজ গুজরাটের এই হাল হল কীভাবে? অনেকেই দায়ী করছেন 'নমস্তে ট্রাম্প'কে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে ব্যাপক অভ্যর্থনার কর্মসূচি যে বুমেরাং হতে পারে তা কী ভাবেননি মোদি? রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানি (রাজ্য সরকারও নমস্তে ট্রাম্পের আয়োজক ছিল) ভাবেননি, সেই সময় করোনা ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে শুরু করেছে। কংগ্রেসের যুক্তি, ২৪ ফেব্রুয়ারি 'নমস্তে ট্রাম্প' লক্ষ-লক্ষ মানুষের (বিদেশি অতিথিদের নিয়ে) জমায়েত করিয়েছে। করোনা ছড়িয়ে সেই কারণেই। বিজেপির পাল্টা যুক্তি, ২৪ ফেব্রুয়ারির অনেক পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO বা হু) কোভিড – 19 কে বৈশ্বিক মহামারী বলে আখ্যা দেয়। রাজ্যের প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা সামনে আসে নমস্তে ট্রাম্পের ১ মাস পর। এই যুক্তি যুদ্ধের মাঝেই উপসর্গহীনতার কথা বার বার উঠে এসেছে। কোভিডের অন্যতম চরিত্র বেশ কিছুদিন উপসর্গহীন ভাবে রোগীর শরীরে থেকে যাওয়া। যা, বিজেপি, কংগ্রেস, রাজ্য সরকার এবং মোদি সরকার ভাল ভাবেই জানে।
কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পা শুরুটা খারাপ করেননি। কিন্তু, তাল কেটে যায় তার পরেই। তাঁর এক মন্ত্রীর মেয়ের বিয়ের বিশাল আয়োজন করা হয়। এক বিজেপি এম এল এ-র ছেলের বিয়েতে নিজেই যান মুখ্যমন্ত্রী। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামী'র ছেলের বিয়ের অনুমতি দেয় ইয়েদুরাপ্পা প্রশাসন। এর মাঝেই কেরলের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে কর্ণাটক। অন্যদিকে, বিহারে বিজেপি এমপি'রা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রলহাদ জোশিরকে খোলাখুলি রাগ জাহির করেছেন। কারণ, অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার কোভিড-19 নিয়ে নাকি বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। সারা ভারতে ছড়িয়ে থাকা বিহারী শ্রমিক এবং ছাত্রদের ফিরিয়ে নিতে নীতিশ কিছুই করছেন না, যা এন ডি এ-তে খারাপ প্রভাব ফেলছে বলে নিজেই মনে করে বিজেপি। এদিকে কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিহারের টিপিএম ছিল মাত্র ২৬৭।