তপন মল্লিক চৌধুরী : ক্ষমতায় এসে যে জঙ্গলমহলকে মুখ্যমন্ত্রী ঢালাও উন্নয়ন দিয়ে সাজাতে শুরু করেছিলেন৷ গত লোকসভা নির্বাচনে সেখানকার একটা অংশের মানুষ তাঁর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। তৃণমূলের হাতছাড়া হয়েছিল ঝাড়গ্রাম এবং পুরুলিয়া দুটি লোকসভা কেন্দ্র। তা নিয়ে দলের অন্দরে অনেক চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে। তবে তৃণমূল সুপ্রিমো মনে করেছেন জঙ্গলমহলের ক্ষত এখনও শুকোয়নি। লোকসভায় জঙ্গলমহলে তৃণমূল বড়সড় ধাক্কা খাওয়ায় সেই মাটিতে শক্ত ঘাঁটি গাড়তে উঠে পড়ে লাগে বিজেপি।
বেশ কয়েকবছর ধরে আদিবাসী এলাকায় নিজেদের ঘাটি গেড়ে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে জঙ্গলমহলের সব ক’টি আসন নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় বিজেপি। এবার সেই সম্ভাবনা গোড়াতেই নির্মূল করতে বিজেপির বিরুদ্ধে ত্রিমুখী আক্রমণের পরিকল্পনা করছে তৃণমূল। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে লাল মাটির জঙ্গলমহলের হারানো জমি পুনরুদ্ধারে মরিয়া তৃণমূল।
শুরুতে দলের পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলা সংগঠন বিরাট রদবদল করেছ তৃণমূল। দলে যে সব স্থানীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাঁদের মূল দায়িত্ব থেকে সরিয়ে সেখানে স্বচ্ছ মুখ নিয়ে এসেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি নতুন মুখদের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।সাম্প্রতিককালেকিছু মাওবাদী কার্যকলাপক ঘিরে উত্তেজনা দেখা ঝাড়গ্রাম তথা জঙ্গলমহলে। সে সব দমন করতে ফের কাউন্টার ইনসারজেন্সি ফোর্সকে সক্রিয় করা হয়।
জুলাই মাসে তৃণমূলের রাজ্য কমিটিতে আনা হয় ছত্রধর মাহাতোকে। জঙ্গলমহলের লালগড়ে মাওবাদীদের সহায়তায় সংগঠিত আদিবাসী আন্দোলনের প্রধান মুখ ছিলেন ছত্রধর মাহাতো। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁকে দলে নেওয়ার নেপথ্যে মূল কারণ হল জঙ্গলমহলে গেরুয়া শিবিরের আধিপত্য কমানো। কারণ, ছত্রধর মাহাতোর এখনও অসংখ্য অনুগামী রয়েছে সেখানে।
ছত্রধর মাহাতোর মতে, দুর্নীতিতে জড়িত কিছু স্বেচ্ছাচারী তৃণমূল কর্মীর বিরোধিতা করে মানুষ ভোট দিয়ে বিজেপি–কে জিতিয়েছে। ২০১৪ থেকেই জঙ্গলমহলের রঙ গেরুয়া হতে শুরু করে, সে সময় ওই এলাকার মোট ভোটের প্রায় ২০ শতাংশ বিজেপি পেয়েছিল। ২০১৮–র পঞ্চায়েত নির্বাচনে আরও বড় ধাক্কা খায় তৃণমূল। ঝাড়গ্রামের ৭৮০টি গ্রামপঞ্চায়েতে ৩৭৩টিতে জেতে তৃণমূল আর বিজেপি যেতে ৩২৯টি। পুরুলিয়ায় ১৯২১টি গ্রামপঞ্চায়েতের মধ্যে ৭৫৪টি তৃণমূল এবং ৫২৮টি পায় বিজেপি। আর ২০১৯–এ সেই ছবি একেবারে বদলে যায়। লোকসভা নির্বাচনে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বিষ্ণুপুর ও ঝাড়গ্রামের সমস্ত আসনে জয়লাভ করে তৃণমূলকে পিছিয়ে ফেলে এগিয়ে যায় বিজেপি।
জঙ্গলমহলে নিজেদের জমি পুনরুদ্ধারে তাই ছত্রধরের উপরেই ভরসা রেখেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া, ছত্রধর তাঁকে রাজ্য কমিটিকে এনে দলছুট কুর্মি সম্প্রদায়কে আবার নিজের দিকে টানার চেষ্টা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঝাড়গ্রামে প্রায় ৩৪ শতাংশ কুর্মি সম্প্রদায়ের মানুষ। পরিসংখ্যান বলছে এরা লোকসভা ভোটে তৃণমূলের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ছত্রধরের ফেরা এবং তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ জঙ্গলমহলের রাজনীতির অঙ্ককে প্রভাবিত করবে বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা।
জনগণের আন্দোলনে ছত্রধরের সঙ্গীদের প্রায় সকলেই এখন তৃণমূলে। আন্দোলন পর্বে ছত্রধরের যারা ছায়াসঙ্গী ছিলেন, বর্তমানে লালগড় ব্লক তৃণমূলের সভাপতি শ্যামল মাহাতো, পুরনো সঙ্গী মনোজ মাহাতো, অসিত মাহাতো, ব্লক যুব তৃণমূলের সভাপতি তন্ময় রায়, ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের সভানেত্রী বিরবাহার প্রত্যেকেই ছত্রধরের ফিরে আশাকে স্বাগত জানিয়েছে। ১১ বছর জেলে কাটানো, জনসাধারণের কমিটির তৎকালীন নেতা ছত্রধর মাহাতো তৃণমূল দলের রাজ্য কমিটিতেদায়িত্ব পেয়েই জঙ্গলমহল পুনঃরুদ্ধারে রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
রাজনৈতিক মহলের একাংশ অবশ্য বলছেন, জঙ্গলমহলে তৃণমূলের ঝাণ্ডা নিয়ে ছত্রধর ফিরতেই পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পাচ্ছে শাসক দল। এই অঞ্চলগুলিতেই লোকসভায় একচেটিয়া সাফল্য পেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু আড়ালে অনেক বিজেপি নেতাও স্বীকার করছেন, জঙ্গলমহলে এক্স ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন ছত্রধর। এমনকী তৃণমূলে যোগ দিয়েই ছত্রধর দাবি করেছেন, জঙ্গলমহল-সহ গোটা বাংলাতেই আবার ক্ষমতায় ফিরবে তৃণমূল। আর এমন পরিস্থিতিতে বহু পুরনো মামলায় ছত্রধরকে এনআইএ-র হেফাজতে চাওয়ার মধ্যে রাজনৈতিক রং খুঁজে পাচ্ছেন অনেকেই।
জঙ্গলমহলে সক্রিয় হয়ে উঠছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ছত্রধর মাহাতো। ছত্রভঙ্গ সংগঠন মেরামতির কাজও তিনি ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন। বিধানসভা নির্বাচনের আগে জঙ্গলমহলের আদিবাসী কুর্মি সমাজ তপশিলি উপজাতি তালিকাভুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করায় শাসক শিবিরে উদ্বেগ বেড়েছে। লোকসভা ভোটের আগেও এই আন্দোলনের জেরে কুর্মি সমাজের বড় অংশ তৃণমূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। লোকসভা ভোটে জঙ্গলমহলে তৃণমূল কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ঝাড়গ্রাম জেলার চারটি বিধানসভা দখলে রাখতে সক্রিয় হয়েছেন ছত্রধর। তিনি নিজের মতো করে সংগঠন তৈরির জন্য রাজ্য নেতৃত্বের কাছে বেশ কিছু প্রস্তাবও দিয়েছেন।তবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে দলের একাংশ জনসাধারণের কমিটির প্রাক্তন নেতা ছত্রধরের উপর ভরসা রাখলেও তাঁর অতীত নিয়ে বিরোধীদের সরব হওয়ার বিষয়টিতে জেলার বেশিরভাগ তৃণমূল নেতাই অস্বস্তিতে পড়েছেন।