সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়: ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন জম্মু-কাশ্মীরের কারাগারে বন্দিদশায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়েছিল৷ সেদিন থেকে এই বঙ্গসন্তানের মৃত্যু নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠেছে৷ এমনকী তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে অনেক সময় অভিযোগের আঙুলও উঠেছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লার দিকে৷
ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খোদ অটলবিহারী বাজপেয়ী ২০০৪ সালের ৬ জুলাই শ্যামাপ্রসাদের জন্মদিন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেছিলেন, নেহরু এবং শেখ আবদুল্লার যড়যন্ত্রেই মৃত্যু হয়েছিল শ্যামাপ্রসাদের৷ তবে বিস্ময়ের ব্যাপার, বার বার তাঁর মৃত্যু রহস্য নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তা খণ্ডাতে এখনও পর্যন্ত কোনও তদন্ত কমিশন গড়া হয়নি৷
শোনা যায়, ১৯৪৭ সালে ১৫ অগস্ট স্বাধীনতার সময় যখন প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করা হয় সেই সময় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু রাজি ছিলেন না শ্যামাপ্রসাদকে তাঁর মন্ত্রিসভায় নিতে৷ মহাত্মা গান্ধী এবং সর্দার প্যাটেলের চাপে নাকি তিনি শেষ পর্যন্ত রাজি হন ৷ অতঃপর শ্যামাপ্রসাদ হন স্বাধীন ভারতের প্রথম শিল্পমন্ত্রী৷ আদর্শগত দিক থেকে জওহরলাল নেহরু এবং শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে একটা দূরত্ব বরাবরই ছিল৷ ফলে ক্যাবিনেটেও নানা কারণে এই দুই নেতার মধ্যে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছিল৷
বিশেষত পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তু সমস্যা এবং তাদের পুনর্বাসন নিয়ে নেহরু অবস্থান না মেনে সরব হতে দেখা যেত তৎকালীন দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ শ্যামাপ্রসাদকে৷ যার জেরে একটা সময় দুজনের বিবাদ চরমে পৌঁছায়৷ তারই জেরে মন্ত্রিসভা ছেড়ে বেরিয়ে এসে শ্যামাপ্রসাদ ১৯৫১ সালে ভারতীয় জনসঙ্ঘ নামে নতুন দল গঠন করেন৷
নেহরুর কাশ্মীর নীতির বরাবরই সমালোচক ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ৷ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানি হানাদাররা কাশ্মীরে ঢোকে৷ বায়ুপথে দুর্লঙ্ঘ্য পার্বত্য বাধা পার হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী তা প্রতিহত করে৷ এর পর পাক হানাদার বাহিনীকে তাড়া করে ভারতীয় জওয়ানরা যখন এগতে আরম্ভ করেন ঠিক তখনই নেহরু রাষ্ট্রসংঘে বিষয়টি উত্থাপন করে কার্যত নিজের পায়ে কুড়ুল মারেন৷ ফলে নেহরুর এই ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ দানা বাধে বিভিন্নমহলে৷ উরি বরাবর ঘোষিত হয় যুদ্ধবিরতি৷ তৈরি হয় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা৷ একদিকে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর৷ আর শ্রীনগরে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন শেখ আবদুল্লা৷
কিন্তু হাতে রাজ্যের ক্ষমতা পেতে না পেতেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়াজ তুলে নেহরুকে ব্ল্যাকমেল করতে আরম্ভ করে দেন শের-ই-কাশ্মীর৷ মূলত শেখ আবদুল্লার চাপেই সেখানে পারমিট প্রথা চালু হয়৷ অর্থাৎ কাশ্মীরে ঢুকতে গেলে ভারতীয় নাগরিককেও পারমিট নিতে হবে৷ সংবিধানে ৩৭০ নং ধারা সংযোজনের সূত্রেই জম্মু-কাশ্মীর এমনতর বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে শুরু করে৷ এসবের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়৷
অতঃপর কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তির বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করেন শ্যামাপ্রসাদ৷ প্রতিবাদস্বরূপ তিনি ঠিক করেন, বিনা পারমিটেই একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে তিনি কাশ্মীরে পা রাখবেন৷ সেই উদ্দেশ্যে ১৯৫৩ সালের ১০ মে দিল্লি থেকে ট্রেনে তিনি পাঠানকোটের দিকে রওনা দেন৷ তিনি জম্মু-কাশ্মীরে প্রবেশ করতেই শেখ আবদুল্লার পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে৷
অনেকেরই ধারণা ছিল, জম্মু-কাশ্মীরে প্রবেশের আগেই শ্যামাপ্রসাদকে গ্রেফতার করা হবে৷ কিন্তু তা না করে তাঁকে কাশ্মীরে ঢুকতে দেওয়া হয়, যাতে তিনি আর কোন ভাবেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে না পারেন৷ আর এটাই ছিল নেহরু এবং শেখ আবদুল্লার মিলিত যড়যন্ত্র৷ এমনই অভিযোগ করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী৷ বাজপেয়ী সহ পুরানো জনসঙ্ঘীদের অনেকেরই মত, এই যে, যদি শ্যামাপ্রসাদকে কাশ্মীরে ঢোকার আগে গ্রেফতার করা হত, তাহলে প্রশ্ন উঠত৷ যেটা নেহরু চাননি৷ কিন্তু তখনও জম্মু-কাশ্মীর সুপ্রিম কোর্টের আওতাধীন হয়নি ৷ জম্মু-কাশ্মীরের আইন ছিল পুরানো রাজ আমলেরই আইন৷ সেই অনুসারে সেখানে আইন অমান্যের অভিযোগে গ্রেফতার হলে মুক্তি পাওয়া কঠিন ছিল৷
তবে গ্রেফতারির থেকেও শ্যামাপ্রসাদের বন্দিদশা ও মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক আরও বেশি৷ যেহেতু জওহরলাল নেহরু সেটিকে ‘পিকচারেক্স বাংলো’বলেছিলেন অতএব নেহরু-বিরোধী অনেকেরই অভিযোগ ছিল, টিলার উপর একটি ক্ষুদ্র কুটিরকে তিনি বলছেন কি না ছবির মতো বাংলো!
শুধু তাই নয়, নেহরু-বিরোধীদের মতে, ওই ক্ষুদ্র কুটিরটিকে একেবারে সাব-জেলে রূপান্তরিত করা হয়েছিল৷ তাছাড়া হার্টের রোগী শ্যামাপ্রসাদ হাঁটাচলা করার আবেদন জানালে তা-ও নামঞ্জুর করেছিলেন শেখ আবদুল্লার পুলিশ৷ তবে তার চেয়েও বড় অভিযোগ, ওই সময় নেহরু স্বয়ং অবসর বিনোদনের জন্য কাশ্মীরে গিয়েছিলেন৷ তবু তাঁর মন্ত্রিসভার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাক্তন সদস্যের সঙ্গে কারাগারে গিয়ে দেখা করার সৌজন্যটুকুও তিনি দেখাননি৷ ওই সময়ই শ্যামাপ্রসাদ অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ দেশের একজন সাংসদ বিনা বিচারে আটক থাকা সত্ত্বেও তাঁর হার্ট অ্যাটাকে নাকি গুরুত্বই দেয়নি জম্মু-কাশ্মীরের প্রশাসন৷ উপরন্তু চিকিৎসকরা অবহেলা করেছিলেন বলেই তাঁর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটেছিল, এই দাবি আজও নানা মহলে৷
সেইসব মহলের অভিযোগ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের শারীরিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে কোন ওষুধ দেওয়া উচিত, কোনটা দেওয়া উচিত নয় সে ব্যাপারে ইচ্ছাকৃতভাবেই সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি৷ এমন কিছু ওষুধ ও ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল যা তাঁর শরীর নিতে পারেনি৷ ২৩ জুন তাঁর মৃত্যুর কথা ঘোষণা করা হয়৷ শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনও ধোঁয়াশা হয়েই রয়ে গিয়েছে৷
ছেলের মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত চেয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে যোগমায়া দেবী আবেদন করেছিলেন৷ কিন্তু সেই আবেদন নাকি নাকচ করে দেন জওহরলাল নেহরু স্বয়ং৷ উলটে তিনি জানিয়ে দেন, তাঁর কাছে যা খবর এসেছে তাতে সন্দেহের কিছু নেই৷ ফলে তদন্তের কোনও প্রয়োজন নেই৷ স্বাভাবিকভাবেই শ্যামাপ্রসাদভক্তদের মনে প্রশ্ন ওঠে, কেন সেদিন জনসঙ্ঘী নেতার মৃত্যুর তদন্তে ভয় পেয়েছিলেন নেহরু? তবে তিনি কি কিছু ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন?
শ্যামাপ্রসাদের মরদেহ কলকাতায় আসার পর যেভাবে জনসমাগম হয়ে ছিল তা লক্ষ করার মতো৷ শ্যামাপ্রসাদের শেষযাত্রায় দীর্ঘ মিছিলে প্রমাণ হয়ে যায়, তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল কোন মাত্রায়৷ তার মানে কি সত্যিই শ্যামাপ্রসাদের জনপ্রিয়তাকে ভয় পাচ্ছিলেন নেহরু? কারাগারের অন্তরালে এই বঙ্গসন্তানের মৃত্যু হল৷ অথচ, দীর্ঘদিন পরেও তা নিয়ে কেন কোনও তদন্ত কমিশন গড়া হল না৷
নেহরুর ধ্বজাধারী কংগ্রেস এই তদন্তে ধামাচাপা দেবে তা বলাই বাহুল্য৷ কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের প্রতিষ্ঠিত জনসঙ্ঘের উত্তরসূরি বিজেপিও তো দিল্লিতে আগে ক্ষমতায় এসেছে এবং এখনও রয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পর অটলবিহারী বাজপেয়ী শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যু নেহরুর ষড়যন্ত্র বলে আঙুল তুলেছিলেন ৷ কিন্তু তিনি নিজেও ছয় বছর যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন কতটা উদ্যোগী হয়েছিলেন এই মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনে? বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও তিনিও তো ক্ষমতায় রয়েছেন গত সাত বছর। কিন্তু তিনিও কি শুধু শ্যামাপ্রসাদের ছবিতে মালা দিয়েই কর্তব্য সারবেন?