বর্তমানে কি অনুপ্রবেশ সবচেয়ে বড় সমস্যা? শিক্ষিতরাও ধন্দে!

বর্তমানে কি অনুপ্রবেশ সবচেয়ে বড় সমস্যা? শিক্ষিতরাও ধন্দে!

কিংকর অধিকারী

কিংকর অধিকারী: এ রাজ্যের বিজেপি সভাপতি মাননীয় দিলীপ ঘোষ মহাশয় বলেছেন, এক কোটি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে এনআরসি করে তাড়ানো হবে। বলা হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত অ-মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে 'নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল' পাস করা হয়েছে। কেননা, তারা নাকি সবাই ধর্মীয় অত্যাচারের ফলে ভারতবর্ষে এসে বসবাস করছে।

প্রথমেই বলি, দিলীপ বাবুর কথা অনুযায়ী যদি কেবলমাত্র মুসলিমদের অত্যাচারের কারণে এদেশে অ-মুসলমান(অধিকাংশই হিন্দু, এছাড়া শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান) লোকেদের অনুপ্রবেশ হয়ে থাকে তাহলে তো অনুপ্রবেশকারীরা সবাই মুসলিম বাদে হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের। তাহলে দিলীপ বাবু কি করে বলছেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের এক কোটি মানুষ পশ্চিমবঙ্গে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে বসবাস করছে? যারা অত্যাচার করেছে সেই বাংলাদেশী মুসলমানরা এখানে আসতে যাবে কেন? তবে কি তারা (মুসলমানরা) হিন্দুদের উপর অত্যাচার করল এবং তাদের(হিন্দুদের) পিছন পিছন পশ্চিমবঙ্গে চলে এলো? এই ব্যাখ্যা কি সঠিক বলে মনে হয়? শুধু দীলিপবাবু নয়, দীলিপ বাবুর সর্মথকরাও বিষয়টি ভেবে দেখবেন।

বলা হচ্ছে, সিএএ বা এনআরসি নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার জন্য নয়, নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য। ধর্মীয় অত্যাচারের কারণেই যদি অনুপ্রবেশ হয়ে থাকে তাহলে বর্তমানে যারা এদেশে রয়েছে এবং অত্যাচারের কারণে এসেছে তাদের সকলকে নাগরিকত্ব দিলেই তো সমস্যা মিটে যেত। আর যদি মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুপ্রবেশকে স্বীকার করতে হয় তাহলে এ কথা মানতে হবে যে, যে কারণে মুসলিমরা এদেশে বা এরাজ্যে এসেছে হিন্দু সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষরাও একই কারণে এসেছে। কেবলমাত্র ধর্মীয় নিপিড়ণের তত্ত্ব এক্ষেত্রে খাটে না। অনুপ্রবেশের সমস্যা কেবলমাত্র ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে নয়, এটি সারা বিশ্বের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে সত্য। রুজি রোজগার বা অর্থনৈতিক কারণে বিশ্বের প্রতিটি উন্নত দেশে পার্শ্ববর্তী অনুন্নত দেশের মানুষ অতীতেও অনুপ্রবেশ করেছে, আজও করছে। ভাষা বা সংস্কৃতিগত মিল থাকলে আরো বেশি করে ঘটতে থাকে। যেমন আমেরিকাতে তার প্রতিবেশী মেক্সিকোর মানুষ অনুপ্রবেশ করছে। আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলি থেকে এখন দলে দলে মানুষ ইউরোপের দেশ গুলিতে ঢুকছে। আর অবৈধভাবে যদি অনুপ্রবেশ হয়ে থাকে তার জন্য দায়ী তো দেশের জনগণ নয়, বর্ডার সিকিউরিটির জন্য জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তার দায় তো কেন্দ্রীয় সরকারের। বর্ডার সিকিউরিটি জন্য বিএসএফ জওয়ানরা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থেকে কাজ করে।  নিজেদের ব্যর্থতার দায় জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কি বারবার এভাবে এনআরসি হতে থাকবে? তার জন্য দেশের ১৩০ কোটি মানুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে?

আসলে যাঁরা বলছেন যে, কেবল ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে এদেশে অ-মুসলমান ব্যক্তিগণ অনুপ্রবেশ করেছে – তা পুরোপুরি সত্য নয়। হ্যাঁ নিশ্চয়ই দেশভাগের সময়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতবর্ষে ব্যাপকভাবে মানুষ এদেশে অর্থাৎ ভারতবর্ষে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। সে সময়ে বহু অত্যাচারের কাহিনী শোনা যায় যা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। পশ্চিম পাকিস্তান যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল তা সর্বজনবিদিত। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারি গুন্ডাবাহিনী যে আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল তা কেবল হিন্দুদের উপর নয়, হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে সকলের উপর নামিয়ে এনেছিল। অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সেই মৃত্যু তালিকায় বেশির ভাগ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন ছিলেন। অত্যাচারের বিভীষিকায় অসংখ্য মানুষ (সব ধর্মের) প্রাণের তাগিদে ভারতবর্ষের পার্শ্ববর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, আসামে আশ্রয় নেয়। সে অত্যাচার ছিল শাসক বনাম শোষিতের। আর দেশভাগের সময় বা তার পরবর্তীতে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা গড়ে উঠেছিল তখনও বহু মানুষ ভারতবর্ষে চলে আসে। ধর্মীয় অত্যাচারের ফলে হিন্দুদের একাংশ এদেশে চলে এসেছে একথা যেমন সত্য তেমনি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু মানুষ এদেশে এসেছে। তারা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। ১৯৭১ সালে যে বিপুল পরিমাণ মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতবর্ষের পার্শ্ববর্তী রাজ্যে এসেছিল পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে ওঠার পর তাদের বিরাট অংশই সে দেশে ফিরে যায় বলে সরকারের দাবি। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে ওঠার পর এদেশে অনুপ্রবেশের হার খুবই নগণ্য।  জনশুমারি থেকে জানা যায় অনুপ্রবেশের কারণে ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৩২.৮% সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তা ছিল ২১.৬৪%। আর ২০০১-১১ দশকে ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল যেখানে ১৭.৬৪% সেখানে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়ায় ১৩.৯৩%। আবার একথা মনে রাখতে হবে যে, সাধারণ মানুষের অনিচ্ছাসত্ত্বেও যখন দেশভাগ(১৯৪৭) হল তখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলমানদের একটা অংশের মানুষ বাংলাদেশে চলে যায়। আর বাংলাদেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু মানুষ পশ্চিমবঙ্গের চলে আসে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেশন রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১ কোটি ৬৬ লাখ মানুষ ভারতবর্ষ থেকে অন্যত্র চলে গিয়েছে। তাহলে কি প্রমাণ হয় যে, বর্তমানে সারাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান সমস্যা অনুপ্রবেশ?  পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে অনুপ্রবেশের হার অতি নগণ্য যা সরকারি পদক্ষেপের মাধ্যমে সহজেই মোকাবিলা করা যায়। তাহলে তা নিয়ে এত উন্মাদনা তৈরি করার কারণ কি?
      
ভারতবর্ষের যত সংকট তার জন্য কি অনুপ্রবেশের ঘটনাই দায়ী? অনুপ্রবেশের ঘটনা তো সীমান্ত প্রদেশের কয়েকটি রাজ্যের সমস্যা। উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে তো অনুপ্রবেশ নেই। সেখানে কেন মাত্র ৩৬৮ টি পিয়ন পদের জন্য ২৩ লক্ষ উচ্চ শিক্ষিত(পিএইচডি, ইঞ্জিনিয়রসহ) বেকারের আবেদন জমা পড়ে? অন্যান্য রাজ্যগুলিতে কেন এত বেকারত্বের সংকট? সারা ভারতবর্ষে কেন তীব্র দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি? অসংখ্য কলকারখানা কেন বন্ধ হচ্ছে? কেন শ্রমিক ছাঁটাই চলছে? কেন চাষীদের আত্মহত্যার মিছিল চলছে? কেন লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি বেকারদের চুক্তির মাধ্যমে সামান্য টাকার বিনিময়ে গাধার খাটুনি খাটিয়ে নেওয়া হচ্ছে? দেশের সকল মানুষের জন্য কি সমানভাবে চিকিৎসার সুযোগ করে দেওয়া গিয়েছে? দেশের ৭০ শতাংশ সম্পদ কেন মাত্র ১ শতাংশ ধনকুবেরদের হাতে? পাহাড় পরিমাণ কালো টাকার মালিকদের আজও টিকি ছোঁওয়া গেল না! এই মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধানে তারা কি বিন্দুমাত্র ভূমিকা পালন করছে? এসব বিষয়ে কি বিজেপি সরকারের কোনো বক্তব্য শোনা যায়? ধরুন এনআরসি করে এক কোটি মুসলমানকে বের করে দেওয়া হল। তারপর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তো?

নোট বন্দির সময়ে আমরা অনেকেই আশা করেছিলাম যে, এর মাধ্যমে সরকার সত্যিই কালো টাকার মালিকদের ধরে ফেলবে। ভবিষ্যতে আর কোনদিন জাল নোট বের হবে না। পাকিস্তানের জঙ্গিরা এর ফলে জব্দ হয়ে যাবে। শত কষ্ট, শত মানুষের মৃত্যু সত্বেও সবাই আমরা দুই হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছিলাম। তারপর কি দেখলাম? যা হওয়ার কথা ছিল কিছুই হয়নি। যা ভাবিনি, তাই হয়েছে। বাতিল হওয়া প্রায় সমপরিমাণ টাকা ফিরে এল ব্যাংকে। বরং কালো টাকার মালিকরা এই সুযোগে তাদের টাকা সাদা করে নিল। আর এর ফলে দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ (১২ হাজার কোটি টাকা) খরচ হয়ে গেল। একটার পর একটা উন্মাদনার রাজনীতিতে মাতিয়ে রেখে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই আসল সমস্যাগুলিকে। প্রত্যেকের ব্যাংক একাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়া বা বছরের ২ কোটি বেকারদের চাকরি দেওয়ার মতো প্রতিশ্রুতির বেলুন আজ ফুটো হয়ে গিয়েছে। দেশের অর্থনীতির হাল যখন ক্রমশঃ নিন্মমুখি তখন দেশের সাধারন মানুষের ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে হবে এনআরসি। এ যেন 'ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই'। এসব নিয়ে কোনো চর্চা নেই! চর্চা যদি করতেই হয় তাহলে এই বিষয়গুলি নিয়ে সারা দেশজুড়ে চর্চা হোক। আর তা না করে শিক্ষিত মানুষরাও যদি ফাঁদে পা দেন তাহলে ধূর্ত শক্তি তো সুযোগ নেবেই।

মতামত লেখকের নিজস্ব৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × three =