তপন মল্লিক চৌধুরী: সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীর ওপর নির্ভরশীলতা কমে গেলে তার খবরদারি কে-ইবা সহ্য করে? সেক্ষেত্রে প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরিতা তৈরি হওয়াটাই সবাভাবিক। যেমনটা হয়েছে এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চিনের ক্ষেত্রে। এই যে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলজুড়ে নিজেদের সমরশক্তি প্রদর্শ, তা কি কেবলই সীমান্ত বিরোধের কারণে? এর পেছনে কি অর্থনৈতিক অহমবোধের কোনো প্রভাব নেই?
ভারত ও চিনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব আকাশ থেকে নেমে আসেনি। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণেই এমন হয়েছে। অবশ্য বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ দুটি কখনই একে অন্যের প্রিয় বন্ধু ছিল না। সীমানা নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ লেগে আছে সেই ১৯৬২ সাল থেকে। তবে সম্প্রতি সীমান্তের উত্তেজনা এতই বেড়েছে যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
অন্তত সাড়ে চার দশকে সীমান্তে হাতাহাতি, লাঠালাঠি, পাথর ছোড়াছুড়ির মতো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লেও কেউই কখনো একে অন্যের ওপর গুলি ছোড়েনি। ভারতের ওপর চিনের ক্ষোভের কারণটা স্পষ্ট। এমনিতেই আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধে বেশ বিপাকে রয়েছে তারা। এর মধ্যে ভারত যেভাবে ঢুকে পড়েছে, তাতে বেইজিংয়ের ক্ষোভ হওয়ারই কথা।
গত বছর চিনকে হটিয়ে ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছে আমেরিকা। ঠিক যেমন ২০০৪ সালে জাপানকে পেছনে ফেলে চিনের সবচেয়ে বড় পার্টনার হয়েছিল আমেরিকা। সেবারের বিষয়টিতে বেইজিং খুশিতে আটখানা হলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এদিকে গত এপ্রিলে নয়াদিল্লি তাদের বিদেশী বিনিয়োগ আইন কিছুটা কঠোর করেছে। বলা হইয়েছিল, চিনকে টার্গেটে রেখেই নাকি সেই পদক্ষেপ। এছাড়া চিন থেকে আসা শেয়ারভিত্তিক বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণেও পরিকল্পনা সাজাতে চেষ্টা করেছে মোদি সরকার।
গত নভেম্বরে বাণিজ্যিক জোট রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ থেকে ভারত বেরিয়ে যায়। সেই জোটের প্রধান উদ্যোক্তা ছিল চিন। তাদের লক্ষ্য ছিল এশিয়ার শীর্ষ অর্থনীতিগুলির সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করা। কিন্তু ভারত বেরিয়ে যাওয়ায় তাদের সেই পরিকল্পনায় কিছুটা হলেও ধাক্কা খায়। নয়াদিল্লির কছেও যুক্তি আছে; চিনের ওপর থেকে বাণিজ্য নির্ভরতা কমানো। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে যেখানে ভারতের মোট রফতানির পরিমাণ যেখানে ৫০ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে এই নয় বছরে চিনে তাদের রফতানি কমেছে ১৪ শতাংশ; যা তাদের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়িয়ে দিয়েছে। আর সেই কারণেই জাতীয়তাবোধের আঁতে ঘা লেগেছে।
দুটি দেশের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে। বাণিজ্যিক সম্পর্ক খারাপ হলে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। আর যদি কোনো দেশ দেখে যে তার বাণিজ্যিক অংশীদারের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে অর্থনৈতিক লোকসানের শঙ্কা রয়েছে, সেক্ষেত্রে তারা সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে ভারত ও চীনের মধ্যকার সীমান্ত দ্বন্দ্ব জাপানকে যথেষ্ট সুবিধাজনক জায়গায় এনে ফেলবে। জাপানের কাছে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি অনেক আগে থেকেই ছিল। চিন-ভারত দ্বন্দ্ব জাপানের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি ঝোঁক আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
পুরো বিশ্ব যখন নয়া অর্থনৈতিক মেরুকরণের চিন্তাভাবনা শুরু করেছে তখন জাপানও নতুন করে তাদের পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য এবং চিনের ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে তাদের বেশকিছু বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান চিন থেকে সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ইতিমধ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরে প্রক্রিয়ায় সহায়তা হিসেবে প্রায় ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। নিরাপত্তা এবং কৌশলগত কারণে সনি, টয়োটা থেকে শুরু করে প্রায় ৮৭টি জাপানিজ কোম্পানি ইতিমধ্যে চিন ছাড়তে রাজিও হয়েছে।
চিন-ভারত সংঘর্ষে ভারতে চিনা পণ্য বয়কট এবং বহু জনপ্রিয়য়াপ নিষিদ্ধ ঘোষণায় জাপান বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়ে উঠবে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, জাপানি বিনিয়োগের জন্য কতটা স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে পারবে ভারত এবং তাদের সংস্থাগুলিকে কতটা নিরাপত্তা দিতে পারছি তার ওপর। প্রসঙ্গত, চিন তার ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর মাধ্যমে ভারত মহাসাগর তীরবর্তী বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছে এবং বিভিন্ন দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ করেছে, ফলে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে কোনো ধরনের গোলযোগ দেখা দিলে জাপানের এই সমুদ্র-বাণিজ্য নিঃসন্দেহে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে।
চিন-ভারত সংঘর্ষে জাপান হয়ত দক্ষিণ এশিয়ায় তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ঘটাতে পারবে না, কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে জাপান তার দক্ষিণ এশিয়া ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতি আরো শক্তিশালী করবে। কারণ অন্তত অর্থনৈতিক কারণে দক্ষিন-এশিয়া যেমন জাপানের কাছে খুবই অর্থবহ, তেমনি এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক এবং কাঠামোগত উন্নয়নের জন্য জাপানের বিনিয়োগ অনস্বীকার্য। অন্যদিকে, যেহেতু ভারত এবং জাপান উভয়েরই শত্রু হিসেবে চিনকেই বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে, ফলে চিন-ভারত যুদ্ধ ভারত-জাপানকে অর্থনৈতিক, সামরিক, এবং কৌশলগত জায়গা থেকে আরো ঘনিষ্ঠ করে তুলবে। একই সঙ্গে চিন-আমেরিকা বাণিজ্য যুদ্ধের দরুন দক্ষিণ এশিয়ায় জাপানের বিনিয়োগ নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পাবে।