নয়াদিলিল্লি: হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, ম্যালেরিয়ার মারণাস্ত্র এই ওষুধ যে কোভিড-১৯ ভাইরাসকেও মেরে ফেলতে পারে সেবিষয়ে গবেষণামূলক কিছু ইতিবাচক সাড়া মিললেও এখনও সেই অর্থে প্রমানিত নয়, তবে বলাই যায় এই ওষুধ ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে এযাত্রায় বাঁচিয়ে দিল।
কথিত আছে, যখন একজন রুপকার যিনি কখনো একাধিক স্তরের বিপণন প্রকল্প পরিচালনা করেছেন আর সেখানে “ভিটামিন”ও বিক্রি হয়েছে, তখন তাঁর কাছে সবকিছুই অলৌকিক ওষুধ মনে হয়।
মার্চ মাসের শুরুতে যখন বিশ্বজুড়ে করোনার প্রভাব বাড়তে থাকে তখন ১৯ ই মার্চ প্রথমবার হাইড্রোক্সাইক্লোরোকুইন অনুমোদন করেছিলেন ট্রাম্প এবং এরপর থেকে এই একটিমাত্র ওষুধের প্রয়োগের ওপরেই জোর দিতে থাকেন তিনি। মার্কিন গবেষক সহ একাধিক দেশের গবেষকরা এই ওষুধের পরীক্ষালব্ধ সাময়িক সাফল্যে নিশ্চিত নন। এমনকি এর মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বার বার সতর্ক করলেও কাজ হয়নি। আর সেই ওষুধটি হলো হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। এই ওষুধ ব্যবহারের জন্য মার্কিনীদের মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ জোগাতে যেন আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন ট্রাম্প। অদ্ভুত সব যুক্তিও খাটিয়ে চলছেন। যেমন, প্রথমদিকে তিনি চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “আমি চাই তারা এটি চেষ্টা করুক।” “ এবং এটি কাজ করতে পারে, এবং কাজ নাও করতে পারে। তবে যদি এটি কাজ না করে তাহলে ক্ষতির কিছুই নেই।”
গত শনিবারও রাষ্ট্রপতি সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন যে আমেরিকায় ২৯ লক্ষ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন মজুত রয়েছে। “হারানোর মত আপনাদের আর কিইবা আছে? এই ওষুধ ব্যবহার করুন, ” এরপর রবিবার, এই অপরীক্ষিত ওষুধের জোরদার প্রচার সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন,”ফ্রান্সে তাদের খুব ভাল পরীক্ষা হয়েছিল,”। “তবে আমাদের কাছে এটা বলার মতো সময় নেই, যে, আসুন কয়েক বছর সময় নিয়ে এটি পরীক্ষা করে দেখি এবং চলুন এবং টেস্ট টিউবের মাধ্যমে এবং পরীক্ষাগারে এর পরীক্ষা চালিয়ে তাই। ” এপ্রসঙ্গে তাঁর আরও অস্বাভাবিক যুক্তি হল,”আমি ডাক্তার নই কিন্তু আমার সাধারণ জ্ঞান আছে।”
আশ্চর্যের বিষয় হল, সংক্রামণজনিত রোগের ক্ষেত্রে আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় ডাক্তার ডাঃ অ্যান্টনি ফৌসি বারবার হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন যে ওষুধটি ব্যবহারের পক্ষে সমর্থন করার মতো কোনো চূড়ান্ত প্রমাণ নেই। গত ২৪ শে মার্চও কোভিড -১৯ এর চিকিৎসা হিসাবে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বিবেচনা করা উচিত কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি স্পষ্টতই জানিয়েছেন – 'না'। করোনা আক্রান্তদের ওপর এই ওষুধের প্রয়োগে নিয়ে বিশ্বের অধিকাংশ গবেষক নির্বিকার থাকলেও, মার্কিন প্রেসিডেন্ট কিন্তু দমে যাননি। এরপরেও তিনি এই ওষুধ ব্যবহারের পক্ষে এমন বহু যুক্তি দিয়ে চলেছেন যা প্রেসিডেন্ট পদের উর্ধ্বে গিয়ে অন্য কোনো ইঙ্গিত বহন করছে বলেই মত ওয়াকিবহাল মহলের। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এনিয়ে নানান মতামত উঠে আসছে। তাঁর এই ওষুধের প্রতি দাবি, আস্হা, গ্রহণযোগ্যতার পেছনে উদ্দেশ্য খুঁজতে শুরু করেছেন অভিজ্ঞ মহল।
যেমন 'দ্য গার্ডিয়ান' পত্রিকা বলছে,- ফক্স নিউজ এবং এলন মাস্কের মাধ্যমে, একটি বিভ্রান্তিমূলক ফরাসী বিশ্লেষনের ভুল তথ্য ব্যপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল যা মার্কিন রাষ্ট্রপতি কাছেও পৌঁছে যায়। আর তারপরেই এই ওষুধ প্রয়োগে জোর দিতে থাকেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। 'দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট' বলছে, এই ওষুধের নেতিবাচক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বা ওষুধের জন্য ট্রাম্পের প্রচার, এর কোনোটাই আসল কারণ নয়। কারণ হিসেবে বিশেষ করে বলা যায়, এই ওষুধকে 'একটা বিশেষ জিনিস' হিসেবে বর্ণনা করেই চলেছেন ট্রাম্প।
কিন্তু এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশ্লেষণ হিসেবে 'দ্য বুলওয়ার্ক'-এ প্রকাশিত টিম মিলারের একটি প্রতিবেদন। মিলার এই সংবাদ মাধ্যমের একজন সহযোগী এবং যোগাযোগ ক্ষেত্রে পরামর্শদাতা। প্রতিবেদন অনুসারে- আমেরিকায় 'আইডিয়াল হেলথ' নামে একটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি যার পোশাকি নাম 'পিরামিড স্কিম', এই নামটি অনেকেই হয়তো জানেন আবার অজানাও হতে পারে। এরা মূত্র পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে কিছু ব্যাক্তিগত ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট বিক্রি করত সেই ১৯৯০-এ। এই সংস্থাটির নিম্ন থেকে মধ্য আয়ের বিক্রেতাদের মধ্যে জাল বিস্তার করে। ভিটামিন বিক্রির পাশাপাশি আরও বিক্রেতাকর্মী নিয়োগ, দুদিক থেকেই কমিশন নিত এই সংস্থা। বিপনন সামগ্রী ও অন্যান্য নেটওয়ার্ক বেনিফিট বাবদ কর্মীদের থেকে মোটা টাকা আদায় করে নিত।
একসময় এই কর্মীরা প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছিল এবং ভিটামিনগুলি বিক্রিও করতে পারেনি। এদের একাংশ সংস্থার বিরুদ্ধে ফেডারেল ট্রেড কমিশনে অভিযোগ জানায়। এই সংস্থার স্বীকৃত পণ্যগুলির মধ্যে একটি 'সুপ্রিম গ্রিন'। এটি ক্যান্সার সারিয়ে তুলতে পারে বলে দাবি করা হতো। তবে তাদের এই দাবি মিথ্যে বলে অভিযোগ ওঠে। এর প্রেক্ষিতে একটি মামলার নিষ্পত্তিও করতে হয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, 'আইডিয়াল হেলথ' আসলে ক্যান্সার নিরাময় সম্পর্কে মিথ্যা খ্যাতির আড়ালে গড়ে ওঠা একটি ভিটামিন 'পিরামিড স্কিম' ছিল।
স্বাভাবিকভাবেই ট্রাম্পকে এখানে কিছু পদক্ষেপ নিতেই হত। পদক্ষেপ হিসেবে ২০০৯ সালে 'আইডিয়াল হেলথ' কিনে নেন ট্রাম্প। এরপর ওয়ার্ল্ড কম ও স্ট্রিংগার বেলের পরামর্শে একটি সমস্যাবহুল সম্পত্তির কিনাড়া করতে সেটা জুড়ে দেন এই সংস্থার সঙ্গে। তিনি এর নাম দেন 'দ্য ট্রাম্প নেটওয়ার্ক'। ট্রাম্পে অধীনে এই সংস্থা গ্রাহক পরিষেবার আশ্চর্য এক একটি পণ্য উৎপাদন শুরু করে। রূপচর্চার সামগ্রী থেকে বাচ্চাদের জন্য 'লো এনার্জি' 'স্ন্যাজেল স্ন্যাক্সেস' সহ আরও নানান রকম সামগ্রী।
এখান থেকে ট্রাম্পের প্রকৃত মান নির্ধারিত হয় একজন 'পিচ ম্যান'(খেলোয়াড়) হিসেবে। আর্থিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে এই 'ট্রাম্প নেটওয়ার্ক' কার্যকরী হয়ে উঠলো। এরপরেই তিনি এই 'আইডিয়াল হেলথ' এর উন্নতিকরণ শুরু করলেন মা উঠতি বিক্রয়কর্মীদের আশার আলো দেখাতে শুরু করল। তাদের আশ্বস্ত করে ট্রাম্প বললেন যারা ট্রাম্পের কথা শুনে চলবে তারা আর্থিক ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার 'চিটকোড' পেয়ে যাবে। এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বা বিপথগামী করার মন্ত্র, অযোগ্য করে তোলা বা যুদ্ধজয়ের আশা জাগানো, যেভাবেই একে ব্যখ্যা করা হোক, এর জন্য কিন্তু ট্রাম্প নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোকে বড়সড় মূল্য দিতে হয়েছে।
ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি মতো যারা এই ব্যবসায় যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা কেউই মন্দা কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারেননি। পরিবর্তে তাদের দুর্দশা এতটাই চরমে পৌঁছে গেছিল যে আর মূল্য দেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না। এবিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট এফটিসি-র অভিযোগ তুলে ধরে জানিয়েছে যে,' ট্রাম্প নেটওয়ার্কে'র সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভরা বলেছিলেন যে “দলীয় কর্মসূচি, বিজ্ঞাপন, স্টার্টার কিটস এবং অন্যান্য উপকরণের জন্য তারা হাজার হাজার ডলার দিয়েছে যার সামান্য অংশও তারা ব্যবসা থেকে কোনোদিন আয় করতে পারেনি।” এফটিসি-র অভিযোগে আরও বলা হয়েছে যে,”তারা মানুষের পকেট খালি করার জন্য তাদের আশা এবং স্বপ্নগুলি ব্যবহার করার চেষ্টা করে।”
মিলারের বক্তব্য, আমেরিকানদের একটি নতুন পরিকল্পনা দরকার। তাদের একটি নতুন স্বপ্ন প্রয়োজন। 'ট্রাম্প নেটওয়ার্ক' স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার সূত্র নিয়ে মন্দা কাটিয়ে ওঠার একটি অনবদ্য পরিকল্পনা গ্রহন করে কয়েক লক্ষ মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার করল। একদিকে মানুষের মনে আশার সঞ্চার করে অন্যদিকে নগদ গুছিয়ে নেওয়া এটা 'আইডিয়ল হেলথ' এর ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত নয় বরং মূলত তাঁর ব্যবসায়িক আদর্শ।
২০১৮ সালে ট্রাম্প পরিবারকে একটি রিকো (র্্যাকেটিয়ার ইনফ্লুয়েন্সড অ্যান্ড কোরাপ্ট অর্গানাইজেশন) মামলার ধাক্কা সামলাতে হয়েছিল। এটি এমন একটি মামলা ছিল যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিছু দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ যারা বিপণন প্রকল্পে হাজার হাজার ডলার রাখার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন না। কিন্তু ট্রাম্পকে ভরসা করেছিলেন। আর সেখান থেকে ট্রাম্প লক্ষাধিক টাকা তুলে নিলেও বিনিয়োগকারীরা পেয়েছিলেন যৎসামান্য, প্রায় কিছুই না পাওয়ায় সমান।
এভাবেই 'ট্রাম্প নেটওয়ার্ক' থেকে এসিএন এবং ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয়, এমন প্রতিটি কেলেঙ্কারীর ক্ষেত্রে একই খেলা চলছিল। ট্রাম্প নিজের ভাবমূর্তি এবং খ্যাতির অপব্যবহার করে প্রতিটি ক্ষেত্রে মিথ্যা আশার ব্যাপারী হয়ে উঠছিলেন। আর সেই ফাঁদে পা দিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় অনেকেই নিজের শেষটুকুও দিয়ে দিয়েছিলেন। আরও নতুন নতুন ভিটামিন তৈরির জন্য, আরও একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে।
কিন্তু সর্বোপরি এর সামগ্রিক চিত্রটা আশাপ্রদ না হওয়ায়, ট্রাম্প এই একই উপায়ে এই একই শোষণ চালিয়ে যেতে অন্য জায়গা খুঁজে নিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিস্তার এভাবেই। তাঁর অন্য কোনও উপায় জানা নেই এবং তার আচরণে পরিবর্তন আনার কোনও উৎসাহও নেই। কারণ তাঁর এই 'কখনও শেষ না হওয়া' প্রতারণাচক্র শেষ পর্যন্ত তাঁকে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে স্থান দিয়েছে। মিলারের প্রার্থনা, “ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই আমারা বাকীরা সম্ভবত ভাগ্যবান হয়ে উঠব এবং হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন বাস্তবিকভাবে কার্যকর হওয়া একটি পরিকল্পনা হিসাবে প্রমানিত হবে। কোনো উদ্যোগের প্রেক্ষিতে মানুষের কিছু মূলধন বাজি রাখা যায় কিন্তু মানুষের জীবন বাজি রাখা যায় না।” সুতরাং, ভবিষ্যৎ বলে দেবে একমাত্র হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের পক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই যুক্তির গভীরতা কতখানি হতে পারে, যেখানে তিনি মার্কিনীদের উদ্দেশ্যে বলছেন “”হারানোর মত আপনাদের আর কিইবা আছে?”