কলকাতা: যোগ্যতা অনুযায়ী বেতনক্রোম চালু ও ১৪ জন শিক্ষকের বদলির নির্দেশ প্রত্যাহারে দাবিতে টানা ৩ দিন ধরে অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ৷ এখনও পর্যন্ত ২০ জন শিক্ষক এই অনশনে অংশ নিয়েছেন৷ তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷ কিন্তু, এই পরিস্থিতির পরও আন্দোলনকারী প্রাথমিক শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শিক্ষামন্ত্রীর কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারির পাল্টা দিলেন প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ৷ শিক্ষামন্ত্রীর হুঁশিয়ারি আগুনে ঘি ঢালছে বলেও দাবি করা হয়৷
মঙ্গলবার অনশনমঞ্চ থেকে শিক্ষক সংগঠনের তরফে বলা হয়, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, আনশনকারীরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে পিছিয়ে দিচ্ছে৷ যেখানে শিক্ষাব্যবস্থা রাস্তায় নেমে এসেছে, উনি তাতে আগুনে ঘি দিচ্ছেন৷ যাতে আমরা আরও আমরা রাস্তায় থাকি৷ যাতে আমরা ভেঙে পড়ে৷ আমি প্রশ্ন তুলছি, ওনার বাস্তব বুদ্ধি কোথায়? উনি বলতে চাইছেন, শিক্ষকরা সমাজের শত্রু৷ দিনের পর দিন প্রেস বিবৃতি করে বোঝাতে চাইছেন, শিক্ষকরা সমাজের শত্রু৷ শিক্ষকরা ইচ্ছাকৃতভাবে রাস্তায় নেমে এসেছেন৷ শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন যে, ওরা অনশন করছে, শিক্ষামন্ত্রীকে টাইট দেওয়ার জন্য৷ শিক্ষামন্ত্রীর এই ধরনের ভাষায় আমরা স্তম্ভিত৷ আমরা এখানে অনশন করছি, আমরা আমদের ন্যায্য দাবি জানাচ্ছি৷ শিক্ষামন্ত্রী, আমাদের অপমান করে নিজের চেয়ারটাকে অপমান করবেন না ৷ উনি নিজেই নিজের সম্মান নষ্ট করছেন৷’’
সোমবার অনশনকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘প্রাইমারি টিচারদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷ আমি আপনাদের খুব দায়িত্ব নিয়ে বলছি, যাঁরা বসে আছে তাঁরা অকারণে বসে আছে৷ আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে, যাতে আপনারা কতটা খবর করবেন তার উপর তাঁদের সাংগঠনিক জোর বাড়বে৷ এটা একেবারেই ভুল৷ সরকারের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমরা লিখেছিলাম যে এদের একটা কিছু ব্যবস্থা করে দেয়া হোক৷ এটা ওঁরাও চিঠিতেও প্রথমদিকে জানিয়েছিল৷ এখন নানা রকম দাবি তুলছেন এবং অনশন করছে৷ এখানে বসে আছেন৷ যে যা পারছে সে তাই করছে৷ চারটে লোক নিয়ে ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন করেছে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করবে৷ একটা অদ্ভুত প্রবণতা দেখা গিয়েছে৷ তারা আলোচনা রাস্তায় না গিয়ে রাস্তায় গিয়ে বসে পড়েছেন৷ রাস্তাতেই তারা বসে ভাবছেন এতে সরকার বোধহয় দুর্বল হয়ে পড়বে, আমাদের কথা শুনবে৷ যেটা বাস্তব সেটাই আগেও বলেছি, আমি আমরা অবশ্যই তাদেরটা ভেবে দেখব৷ শীঘ্রই আমরা প্রাইমারি টিচারদের মিটিং ডাকছি৷ সেখানে সরকারের তরফে যা বলার তা বলা হবে৷ এছাড়াও কয়েকটি সমস্যা আছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করে সবুজ সংকেত নিয়ে আমরা শীঘ্রই নজরুল মঞ্চে আলোচনায় বসবো৷ যেহেতু ২১ তারিখ ধর্মতলা সভা আছে, তার আগে হয়তো সম্ভব হবে না৷ আর যদি তা না হয়, এই মাসেই আমরা তিনটি বিষয়ে সমাধানের পথে যাব৷ এছাড়াও প্রাইমারি প্রাইমারি টিচারদের গ্রেড পে নিয়ে যে একটা নিজেদের মধ্যে একটা অসন্তোষ আছে, সেটা সমাধান করব৷’’
বলেন,‘‘উস্তিদের সঙ্গে বহুবার বসেছি৷ যখন বিধানসভার চলছিল, তখন তাঁদের সঙ্গে বসেছি৷ ওদের মনে হচ্ছে যে, একটু দিচ্ছি আরও একটু যদি সরকারকে টাইট দেওয়া যায়৷ কিন্তু কোনও দিন যা বলিনি তাই আজ বলছি৷ স্কুল কামায় করে যারা আন্দোলনে বসছেন, তাঁদের কিন্তু এই অপশনের জন্য যদি কোনো ছুটি না থাকে, তাহলে কোন ছুটি এডজাস্ট হবে না৷ যারা ছাত্রদেরকে না পড়িয়ে দিনের পর দিন নানা ধরনের আন্দোলন করছেন, স্কুল কামাই করেছেন, তাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি, ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে কাজে ফিরিন৷’’
অন্যদিকে, রাজপথে বসে শিক্ষকদের এই অনশন কর্মসূচিকে সমর্থনের জন্য এগিয়ে এলেন মন্দাক্রান্তা সেন থেকে শুরু করে অম্বিকেশ মহাপত্র ও চিত্র পরিচালক অনিক দত্তরা৷
আজ সোমবার দুপুরে তিনি তাঁরা যান উন্নয়ন ভবনের পাশে শিক্ষকদের অনশন মঞ্চে৷ কথা বলেন শিক্ষকদের সঙ্গে৷ কবিতা পাঠ করে আন্দোলনকে সমর্থন জানান মন্দাক্রান্তা৷ তিনি নিজেও বসে পড়েন প্রতীকী অনশনে৷ অশনরত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করেন, কোথায় তাঁদের সমস্যা? পরে, শিক্ষকদের পাশে দাঁড়িয়ে রাজ্যকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন অম্বিকেশ মহাপত্র, অনিক দত্ত ও মন্দাক্রান্তা সেন৷ এর আগেও এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের অনশন মঞ্চে গিয়েও অনশন বসেন মন্দাক্রান্তা সেন৷
উৎসবের পেছনে দেদার অর্থ খরচ করছে রাজ্য সরকার৷ ২ লক্ষ টাকা করে অর্থ দিতেও খামতি নেই সরকারের৷ কিন্তু, রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি মেটাতে কেন এত অনীহা? ভারতবর্ষে যেখানে প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট বেতনক্রম বেঁধে দেওয়া হয়েছে সেখানে পশ্চিমবঙ্গে কেন এই বেতন বৈষম্য? মানুষ গড়ার কারিগর যদি সমস্যা থাকে তাহলে কোথায় দাঁড়াবে বাংলার প্রথমিক পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ? একদিকে বেতন বৃদ্ধির দাবি, অন্যদিকে শিক্ষকদেক দূরে বদলির প্রতিবাদ৷ শিক্ষামন্ত্রীর কাছে বারংবার দাবি জানিয়েও সমস্যা সমাধান না হওয়ায় এবার রাজপথ আগলে টানা দু’দিন ধরে অনশনে বসলেন প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ৷ ইতিমধ্যেই তিন জন অসুস্থ্য৷
শিক্ষকদের দাবি পূরণ না হওয়ার কারণেই রাজপথে অনশনে বসলেন প্রাথমিক শিক্ষকরা৷ যতক্ষণ না পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধি দাবি ও বদলির নির্দেশ প্রত্যাহার করা হচ্ছে, ততক্ষণ এই অনশন কর্মসূচি চবলে বলে জানা গিয়েছে৷ শুক্রবার দিনভর বিক্ষোভ, রাতভর ধর্নার পর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিন জন শিক্ষিকা৷ এবার নতুন করে অনশন কর্মসূচির ঘোষণায় বেশ বিপাকে রাজ্য শিক্ষা দপ্তর৷ উন্নয়ন ভবনের সামনে আজ দুপুর একটা থেকে শুরু হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষকদের অনশন কর্মসূচি৷
তবে, শিক্ষকদের এহেন অন্দোলন ভালো চেখে দেখছে না রাজ্য৷ সাংবাদিক বৈঠক থেকে রাজ্য সরাকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়৷ যে প্রাথমিক শিক্ষকরা বেতনের গ্রেড নিয়ে আন্দোলন করছেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ইঙ্গিত দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী৷ উন্নয়ন ভবনের সামনে অবস্থান করা শিক্ষকদের ক্ষেত্রে কড়া মনোভাব দেখানো হবে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী৷ এই শিক্ষকরা ছুটি না নিয়ে এসে অবস্থান করে থাকলে তাঁদের বেতন কাটা যেতে পারে বলেও ইঙ্গিত মিলেছে৷ শিক্ষা দপ্তর যদি আন্দোলনরত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তাহলে শিক্ষকদের তরফে চূড়ান্ত আন্দোলনেরও হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখা হয়েছে৷
শুক্রবার দিনভর বেতন বৃদ্ধি ও বদলির নির্দেশ প্রত্যাহারের দাবিতে মিছিল করেন প্রাথমিক শিক্ষকদের একটি বড় অংশ৷ কয়েক হাজার প্রাথমিক শিক্ষক বিকাশ ভবনের বিক্ষোভ দেখান৷ দীর্ঘ দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসা প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি মেটানোর বিজ্ঞপ্তি জারির দাবিতে দেখান বিক্ষোভ৷ কিন্তু, দিনভর রাজ্যের তরফে কোনও উদ্যোগ না নেওয়ার অভিযোগ তুলে রাজপথ আগলে ধর্নায় বসে পড়েন প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ৷ খোলা আকাশের নীচে রাস্তার উপর ত্রিপল পেতে বসে পড়েন শিক্ষকরা৷ আন্দোলনে গিয়ে চূড়ান্ত সমস্যায় পড়েন শিক্ষিকারও৷ সৌচালয় থেকে প্রয়োজনীয় পানীয় জল না পেয়ে সমস্যা পড়েন তাঁরা৷ তবে, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে অনড় প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ৷ এবার অনশনেও সামিল কয়েকশো শিক্ষক৷
উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদিকা পৃথা বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমাদের ১৪ জন সহকর্মী শিক্ষকের অনৈতিক বদলি ও আলোচনা সাপেক্ষে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য বৈষম্য দূর করতে হবে আমরা রাতভর ধর্না দিয়েছি৷ যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের এই দু’টি দাবি একই সঙ্গে শিক্ষা দপ্তর মেনে নিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এখানেই বসে থাকবো, আমরণ অনশন করব৷ শিক্ষকদের অনুরোধ করবো, আপনারা আসুন৷ শিক্ষক ঐক্য কোন জায়গায় যেতে পারে, তা আমরা রাজ্য সরকারকে দেখিয়ে দিই৷ সরকারের পক্ষ থেকে যতদিন পর্যন্ত আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা রাস্তায় থাকবো৷ আমরা আমরণ অনশন চালিয়ে যাব৷’’
শুক্রবার দুপুরে করুনাময়ী থেকে বিকাশভবন পর্যন্ত বিশাল মিছিল করেন শিক্ষকরা৷ জানান তাঁদের দাবি৷ বেতন বৃদ্ধির লিখিত প্রতিশ্রুতি ছাড়া কোনও ভাবেই কর্মসূচি তুলে নেওয়া হবে না বলে ঘোষণা উস্তি ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশনের৷
রাজ্যকে দেওয়া ১৫ দিনের চূড়ান্ত সময়সীমার মধ্যে বেতন বৃদ্ধির আশ্বাস ছাড়া সরকারি কোনও সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ায় আজ রাজপথে নামেন প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ৷ গত ২৪ জুন ধর্মতলা অভিযানে নেমে পুলিশি তাণ্ডবের শিকার হওয়ার পরও থামছে না যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন বৃদ্ধির দাবি৷ শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর ১৫ দিনের সময়সীমা দেওয়া হলেও তা কার্যকর না হওয়ায় আজ ফের রাজপথে নেমে রাজ্য বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ডাক দেওয়া হয়৷
প্রাথমিক শিক্ষকদের অরাজনৈতিক সংগঠন উস্তি ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সভাপতি সন্দীপ ঘোষ ও সম্পাদক পৃথা বিশ্বাস জানিয়েছেন, ‘‘আমরা যে পে স্কেল জমা দিয়ে এসেছিলাম, শোনা যাচ্ছে রাজ্য সরকার অন্য স্কেল দিতে চাইছে৷ যেটা সাধারণ শিক্ষকরা মেনে নেবেন না৷ ১৪ জন শিক্ষককে অনৈতিক ভাবে জেলার বাইরে বদলি করা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, একদিনের মধ্যে ব্যবস্থা নেবেন৷ সেটাও এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি৷ আমরা চাই, আমাদের সংগঠন এই রাজ্যের সব প্রাথমিক শিক্ষকদের যোগ্যতা অনুযায়ী ন্যায্য বেতন নিয়ে লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন, তাই পে রিভিউ কমিটির সঙ্গে আলোচনার জন্য আমাদের সংগঠনকে ডাকা হোক৷ অনৈতিক ভাবে বদলিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিজের জেলায় ফেরত আনা হোক৷’’
তাঁরা আরও জানিয়েছেন, ‘‘আমরা সরকারের কাছে যে স্কেলের দাবি জানিয়েছিলাম ও শিক্ষামন্ত্রী কাগজে লিখে নিয়েছিলেন, সেই স্কেল দেওয়া হোক৷ আমরা সরকারের কাছ থেকে আগামী ১০ জুলাই দুপুর ১২টার মধ্যে এই বিষয়ে লিখিত মতামত চেয়েছিলাম৷ কিন্তু, তা না হওয়ায় আজ ফের আমরা রাস্তায় নামব৷ এবার নামব বিকাশভবনের সামনে লাগাতার অবস্থানে বসলাম৷ আশা রাখি, পশ্চিমবঙ্গের সরকার ১ লক্ষ ৮৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকদের আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না৷’’