কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা রদের বর্ষপূর্তিতে দু’দিন ধরে কার্ফু কেন?

কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা রদের বর্ষপূর্তিতে দু’দিন ধরে কার্ফু কেন?

তপন মল্লিক চৌধুরী: ঠিক এক বছর আগের ৫ অগস্ট ভারতে নতুন এক ইতিহাস তৈরি করেছিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। জম্মু–কাশ্মীরের ওপর থেকে তারা তুলে নেয় বিশেষ মর্যাদা। বাতিল করে সংবিধানের ৩৭০ ধারা। তৈরি হয় দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ।

সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেন যে জম্মু-কাশ্মীরের ওপর থেকে সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ অনুচ্ছেদের ধারা তুলে নেওয়া হল। যার অর্থ বিশেষ মর্যাদা আর থাকছে না জম্মু-কাশ্মীরের। তার বদলে দু'টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে উপত্যকাকে ভাগ করে দেওয়া হয়।

উপত্যকার বিশেষ মর্যাদা তুলে নেওয়ার দিনই জম্মু-কাশ্মীরের তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা, ওমর আবদুল্লা ও মেহবুবা মুফতি-সহ বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার বা গৃহবন্দি করা হয়েছিল। তারপর গোটা উপত্যকায় জারি হয়েছিল কড়া নিয়ন্ত্রণ।

৩৭০ ধারা রদ নিয়ে উত্তাল হয়েছিল দেশের রাজনীতি। এসবই এক বছর আগের ঘটনা। তবে ২০১৯-এর ৫ অগস্টের ওই ঘটনার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল আগেই। অন্তত সপ্তাহ দুই আগে কাশ্মীরে বিভিন্ন নিরাপত্তা রক্ষী সংস্থার কর্তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওইদিন কিছু একটা ঘটতে চলেছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে তাঁদের বলা হয়েছিল, যে কোনও পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

যে কোনও অশান্তি ঠেকানোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়াই ছিল। রাজ্য জুড়ে এমন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল যা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরে কেউ দেখেনি। কাশ্মীর উপত্যকায় বাড়তি আধা সেনা মোতায়েন থেকে সিআরপিএফের ৪৩ টি কোম্পানি অর্থাৎ ৪৩ হাজার আধা সেনা কাশ্মীরের নানা জায়গায় রাখা হয়েছিল।

উপত্যকাজুড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ইন্টারনেট পরিষেবা। বন্ধ হয়েছিল যোগাযোগ ব্যবস্থাও। কোথাও দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলে যাতে সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, সেজন্য ৬০ জন স্পেশ্যাল এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁদের বলা হচ্ছিল ‘মোবাইল ম্যাজিস্ট্রেট’।

বছর ঘুরে আসতেই ফের সেই দিনে নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হল উপত্যকা। জারি হল কার্ফু। আগামীকাল বুধবার পর্যন্ত কাশ্মীরে কার্ফু জারি থাকবে। কেন? শ্রীনগরের জেলাশাসক বলেছেন,  খবর আছে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ও পাকিস্তানের মদতপুষ্ট কিছু দল এই ৫ আগস্টকে কালো দিন হিসেবে দেখে। তাই এই দু’দিন উপত্যকায় দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা চলতে পারে। নাশকতার সম্ভাবনাও আছে। তাই সবদিক দিয়েই নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে।

পাঁচ বছর আগে কাশ্মিরের তরুণ-তরুণীদের প্রিয় নাম ছিল বুরহান ওয়ানি। সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের কমান্ডার ছিল বছর কুড়ির সেই সুদর্শন তরুণ।  সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে সশস্ত্র লড়াইয়ের বিজ্ঞাপন তার মতো কেউ আগে কখনও করতে পারেনি। ২০১৬ সালের ৮ জুলাই গোপন খবরের ভিত্তিতে সেনাবাহিনী আর পুলিশ মিলে সেই বুরহানকে হত্যা করে, শোকস্তব্ধ কাশ্মির অচল হয়ে ছিল মাসের পর মাস।

বুরহান ওয়ানির পর হিজবুল মুজাহিদিনের নেতা রিয়াজ নাইকুরও মৃত্যু হয়েছে সেনাবাহিনীর গুলিতেই। করোনা আর লকডাউনের মধ্যে কাশ্মিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলছে পুরোদমে, তাতে বলি হয়েছেন রিয়াজ নাইকু ছাড়া আরও অসংখ্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বছরের পর বছর ধরে কাশ্মিরের সশস্ত্রপন্থী নেতারা সেখানকার যুবকদের কাছে যে অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন, ৩৭০ ধারার বিলোপ সেই প্রবণতায় কি আদৌ কোনও পরিবর্তন আনতে পেরেছে?

হ্যাঁ কাশ্মিরের তরুণরা রাস্তায় নেমে পাথর ছোড়ার উৎসাহই হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু পাথর ছোড়ার সঙ্গে কাশ্মিরের বিশেষ স্বীকৃতি বাতিলের কি আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে? কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে আসার পর দিল্লি নাকি কাশ্মিরের উন্নয়নে জলের মতো টাকা খরচ করছে।

এলাকায় সরকারি কাজ হওয়া মানে স্থানীয় তরুণদের  ঠিকাদারি ইত্যাদি কাজ পাওয়া। রোজগারের নিশ্চয়তা থাকলে কে আর জঙ্গিবাদ বা অনিশ্চিত পথে পা বাড়াবে। যদিও উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ দিয়ে জঙ্গিবাদ  মোকাবিলা করা যায় কিনা, এই বিতর্ক অনেক পুরনো। কিন্তু এর সঙ্গেই বা ৩৭০ বিলোপের কি সম্পর্ক?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen − one =