কলকাতা: নভেম্বরেই রাজ্যে মহাগুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা উপনির্বাচন৷ নদীয়ার করিমপুর, উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর সদর কেন্দ্রের উপনির্বাচনে অন্যতম প্রধান অ্যাজেন্ডা হিসাবে উঠে এসেছে জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ (এনআরসি) ইস্যু৷
প্রসঙ্গক্রমে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারের সঙ্গে এনআরসি বিষয়ে সম্মুখ সমরে নেমেছেন তৃণমূল৷ অসমে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়ার পর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিরোধী প্রচার শুরু করেছিল তৃণমূল৷ কিন্তু সেই প্রচার লোকসভা নির্বাচনে খুব বেশি কাজে আসেনি৷ বিজেপি ১৮টি আসন দখল করে শাসক দলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে৷ তা-ই উপনির্বাচনে পরিচিত এনআরসি ফর্মুলাতেই হাঁটতে চাইছে বিজেপি৷ করিমপুর, কালিয়াগঞ্জ, খড়গপুর সদরে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে কোন দল কী অবস্থায় রয়েছে তা দেখে নিলে পাওয়া যাবে, বিজেপি কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে কালিয়াগঞ্জ এবং খড়্গপুর সদরে৷ করিমপুরে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল৷ এই তিন কেন্দ্রেই এনআরসি-এর পক্ষে ব্যাপক প্রচার শুরু করেছে বিজেপি৷ বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার জেলা নদীয়া৷ তবে করিমপুর বিধানসভা কেন্দ্রটি মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে৷
বাংলার বিজেপি নেতারা জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ (এনআরসি) ইস্যুটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার নীল-নক্সা তৈরি করে ফেলেছেন৷ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরে বিজেপি নেতারা এনআরসি নিয়ে প্রচারের সদর্থকতা বুঝতে পেরেছে৷ উপনির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশিত হওয়ার আগে থেকেই ওই কেন্দ্রগুলিতে এনআরসি নিয়ে প্রচার করতে শুরু করেছে বিজেপি নেতারা৷ এলাকার তৃণমূল নেতারা যেমন বলছেন, বাংলায় এনআরসি হবে না, তেমনই বিজেপি নেতারা এনআরসি-এর পক্ষে প্রচার শুরু করেছেন৷
প্রথমত, বিজেপির তরফ থেকে বলা প্রচারে জানানো হচ্ছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তৈরি হবার কয়েক বছরের মধ্যেই আবার সেদেশে অত্যাচার এবং ধর্মীয় বৈষম্য শুরু হয়৷ তফশিলী জাতির হিন্দু সম্প্রদায়, যাঁরা সাহস করে স্বাধীন বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিলেন, তাঁরা যেদিন দেখেছেন তা মুখে বলা যায় না৷ ভাবলেও অবাক লাগে, বাংলাদেশে এক সময় হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশ, তা এখন কমে হয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ৷ পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে বেআইনি ভাবে অনুপ্রবেশকারীরা পশ্চিমবঙ্গে জনবিন্যাসের বিপর্যয় ঘটিয়েছে৷ সেই জন্যই দরকার এনআরসি৷
দ্বিতীয়ত, ১৯৫১ সালে ১৯ শতাংশ মুসলমান ছিল পশ্চিমবঙ্গে৷ বর্তমানে সংখ্যাটি বেড়ে হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ৷ এই বিষয়ে রাজ্যে সিপিএম, বামদলগুলি, কংগ্রেস এবং তৃণমূল, কংগ্রেস নীরব, কারণ ভোটব্যাঙ্ক৷ অনুপ্রবেশকারীরাই এই দলগুলির শক্তি৷ অনুপ্রবেশকারীদের বৈধ নাগরিক বানিয়ে ভোট বাড়ানোর কাজ দীর্ঘদিন ধরেই সিপিএম-কংগ্রেস এবং তৃণমূল করে গিয়েছে৷
তৃতীয়ত, বুদ্ধিজীবী এই ইস্যুতে কিছু বলবেন না কেন? বাংলাদেশ গঠনের পর এবং ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর হাজারে হাজারে বাংলাদেশীরা রাজ্যে ঢুকেছে৷ কেউ ঠেকায় নি৷ কাজ করেছে বাম ভোটব্যাংক হিসেবে৷ এনআরসি প্রয়োগে প্রয়োজন এই কারণেই৷
চতুর্থত, ১৯৯০ সালের ৬ মে, দেশের কমিউনিস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত (সিপিআই দলের) লোকসভায় দাঁড়িযে বলেছিলেন, ভারতে ১ কোটি বাংলাদেশী বসবাস করে৷ ১১ অক্টোবর ১৯৯২ সালে গণশক্তি পত্রিকায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু লিখেছিলেন, ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বিএসএফ ২ লক্ষ ৩৫ হাজার ৫২৯ জন বাংলাদেশীকে তাড়িয়ে দিতে পেরেছে৷ সুতবাং অভিযোগ মিথ্যা নয়৷
পঞ্চমত, ১৪ জুলাই ২০০৪ সালে কংগ্রেসের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ জয়সোয়াল লোকসভায় জানান, ভারতে মোট ১কোটি২০লক্ষ৫৩ হাজার৯৫০জন বাংলাদেশী বসবাস করে৷ আবার, একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, ২০০৫ সালে লোকসভাতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুপ্রবেশ ইস্যুকে কেন্দ্র করে স্পিকারের মুখে কাগজ ছুঁড়ে মারেন৷ সুতরাং, অনুপ্রবেশ যে ভয়ানক সমস্যা তা জ্যোতি বসু থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সকলেই জানতেন৷ কিন্তু ভোটব্যাংক সামলাতে এখন অবস্থান বদলেছেন মমতা৷
এছাড়া বিজেপি সাফ জানাচ্ছে, বাংলাদেশী মুসলমানদের আটকালেও কোনও হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান উদ্বাস্তু বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না৷ কারণ ২০১৫ সালে পাসপোর্ট ও বিদেশী আইন সংশোধন করা হয়ে গিয়েছে৷ নাগরিত্ব (সংশোধনী) বিল আইন হিসাবে আসবে৷ আগামী দিনে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান উদ্বাস্তুরা নাগরিত্ব পেয়ে যাবেন৷ অমিত শাহ রাজ্যে বলে গিয়েছেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএবি পাশ করে তবেই বাংলায় এনআরসি হবে৷
বিজেপি বোঝাচ্ছে, রাজ্য সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের বেআইনিভাবে রাজ্যে আশ্রয় দিয়েছে৷ রাজ্যের বেকারদের কাজ কেড়ে নিচ্ছে অনুপ্রবেশকারীরা৷ ওরাই ছিনিয়ে নিচ্ছে ১০০ দিনের কাজ, গ্যাসের ভরতুকি৷ পাশাপাশি মদত দিচ্ছে হিংসার রাজনীতিকে৷ তবে শুধুমাত্র বাংলাদেশি মুসলমানদের চিহ্নিত করা হবে৷ ভারতীয় মুসলমানদের নয়৷ ভারতীয় মুসলমানরা আমার-আপনার দেশভাই – প্রচার শুরু করা হয়েছে বিজেপির তরফে৷