সিপিএমের হয়ে মমতার বিরুদ্ধে কেন গলা ফাটাচ্ছেন দিলীপ ঘোষ? কী উদ্দেশ্য?

সিপিএমের হয়ে মমতার বিরুদ্ধে কেন গলা ফাটাচ্ছেন দিলীপ ঘোষ? কী উদ্দেশ্য?

 

দেবময় ঘোষ: বৃহস্পতিবার রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ যা বলেছেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। দিলীপের অভিব্যক্তি স্বাভাবিক এবং স্পষ্ট। রাজ্য বিজেপির সভাপতির কথায়, সিপিএমের ক'জন এমপি, এমএলএ জেল খেটেছে? দুর্নীতিতে কতজন যুক্ত ছিলেন? অন্যদিকে, এরাজ্যে দুর্নীতির রেকর্ড করেছে তৃণমূল সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পার্টির দিকে তাকিয়ে কথা বলা উচিত। রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষের এই সিপিএম প্রীতির কারণ – গাণিতিক, সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক।

মমতার পূর্ব বক্তব্য: 

বুধবার হাজরা মোড়ে কলকাতা পুলিশের একটি অনুষ্ঠানে মমতা দাবি করেন – সিপিএম আমলে পঞ্চায়েতের দুর্নীতি, চুরি ছিল ১০০ শতাংশ। সেই পুরান অভ্যাস থেকে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যুক্তি দিয়েছেন, তাঁর সরকারের প্রায় ১০ বছরের শাসন কালে সিপিএমের ৩৪ বছরের পঞ্চায়েত দুর্নীতি ঢাকা দিতে পারা যায়নি। ৭-৮ শতাংশ থেকে গিয়েছে।

সিপিএমের সমর্থনে দিলীপ ঘোষের পাল্টা যুক্তি:

মমতার ওই যুক্তি প্রসঙ্গে রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপকে উধৃত করে বলা যায় – “উনি (মুখ্যমন্ত্রী) বলছেন ঠিকই। উনি বলতেই থাকেন। কথার কোনও মাথামুণ্ডু থাকে না। যদি এতই স্বচ্ছ আপনার প্রশাসন, তবে ওর মন্ত্রী, এমপি, এমএলএ'রা জেল খাটছেন কেন? ইডি, সিবিআই-এর ডাকে প্যারেড করছেন কেন? ভুবনেশ্বর যেতে হচ্ছে কেন? ওনার নিজের মন্ত্রীকে ওনার সরকার সাজা দিয়েছে। ৮০ হাজার কোটি টাকার চিটফান্ড কেলেঙ্কারি, সেটা ওনার আমলেই হয়েছে। আজকে টিএমসি'র পঞ্চায়েত মেম্বার থেকে পার্লামেন্ট মেম্বার, কেউ দুর্নীতির বাইরে নয়। সবার দিকে আঙ্গুল উঠছে। সবার গায়ে কালি লেগেছে। এমন কোনও প্রকল্প নেই, যেখান থেকে কাটমানি খাওয়া হচ্ছে না।” দিলীপ আরও বলেছেন, – “কেন্দ্রীয় সরকারের যে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, সেখান থেকে ২০-৩০ হাজার টাকা নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। একটা বাড়ির জন্য ৫০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। বাড়ি কম তৈরি হচ্ছে। সুন্দরবন এলাকায় এত কাঁচা বাড়ি। মানুষ ঝড়ের পর গৃহহীন। মিড-ডে মিলের চাল চুরি, টাকা চুরি এবং নিচু মানের চাল-ডাল দেওয়া হচ্ছে। রেশন কেলেংকারি, খাদ্য সচিবকে সরাতে হল। হাসপাতালের বেডে নিয়ে কেলেঙ্কারি। ভর্তি করতে টাকা নেওয়া হচ্ছে। আমফনের দুর্নীতি। হাজার কোটি টাকার মধ্যে বেশিরভাগটাই ওদের পার্টির হাতে চলে গিয়েছে।”

সিপিএম প্রসঙ্গে মমতাকে দিলীপের প্রশ্ন:

“সিপিএমের এম এল এ, এম পি'রা তো জেল খাটেন নি। মন্ত্রীরা জেল খাটেননি। অভিযোগ এসেছে তাদের নামে। আমি অস্বীকার করছি না, সিপিএমের আমলে দুর্নীতি হয়নি। কিন্তু উনি যেভাবে বলছেন, আজকে ওনার উপর থেকে নিচে, নেতা থেকে মন্ত্রী কে দুর্নীতির মধ্যে নেই? কে ডাক পাচ্ছে না? পাবলিক এমপি, এম এল এ-কে রাস্তায় ঘেরাও করছে কেন? পার্টি অফিস ঘেরাও কেন করছে? প্রধানকে কেন তালা মেরে দিচ্ছে। এইগুলি তো আমরা দেখিনি। সিপিএমের শেষের দিকে রেশন দুর্নীতি হয়েছিল। সেই নিয়ে সারা পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলনও হয়েছিল। এরা সব কিছু পর করে গিয়েছে। সেই জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের পার্টির দিকে তাকিয়ে কথা বলা উচিত। মানুষ সব বোঝে।

দিলীপের সিপিএম স্তুতির রাজনৈতিক কারণ:

নরেন্দ্র মোদি থেকে অমিত শাহ, জে পি নাড্ডা – এই বিজেপির তাবড় নেতা এই রাজ্যে এসে বলেছেন, ৩৪ বছরে বাম আমলে বাংলার মানুষ এই দুর্নীতি দেখেনি, যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসন কালে তারা দেখছে। রাজনৈতিক কারণ স্পষ্ট, বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে গেলে বিরোধী ভোট ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। বাম-কংগ্রেস জোটের জন সমর্থন নেই তা বিশ্বাস করে না 'গেরুয়া শিবির' , বরং অধিক মমতা বিরোধী এবং সিপিএম বিরোধী ভোট একজোট করাই মোদি-শাহ'র লক্ষ্য। বিজেপি মনে করে ২০২১ এর নির্বাচনে তা-ই পাশা পাল্টে দিতে পারে।

সাংগঠনিক: 

২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে থেকেই বিজেপি রাজ্যের সংগঠন মজবুত করতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্রে এর আগে বিজেপির অবস্থান যে ছিল না তা নয়। কিন্তু তা ছিল প্রায় গুরুত্বহীন। বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে কোনও রাজনৈতিক শক্তি বলে মনেই করত না। যদিও সেই সময় পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপির সাংসদ সংসদ ভবনে পৌঁছেছে। কিন্তু, খাতায় কলমে বিজেপি থেকেও ছিলই না। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে দিলীপ ঘোষ এমএলএ হিসাবে নির্বাচিত হন৷ দিলীপের সঙ্গে জেতেন স্বাধীন কুমার সরকার ও মনোজ টিগ্গা৷ তবে, ২০২০ সালে এসেও বিজেপিকে সংগঠন মজবুত করার ব্যাপারে অন্য দলের দলছুটদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। মমতা এবং তৃণমূল বিরোধী সিপিএম-কংগ্রেস কর্মীদের একটি বড় অংশ দিলীপ ঘোষকে পছন্দ করেন। ঠিক যে কারণে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, কান্তি গাঙ্গুলিদের সৎ রাজনৈতিক নেতা বলেন মমতা, ঠিক সেই কারণেই মমতাকে জবাব দিতে দিলীপের সিপিএম স্তুতি।

গাণিতিক কারণ:

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিপিএমের সাধারণ সম্পদক সীতারাম ইয়েচুরি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে এই সাংবাদিককে বলেছিলেন, তৃণমূলের থেকে বাঁচতে মানুষ বিকল্প পথের সন্ধান করেছিল। সেই কারণেই বিজেপিকে ভোট দিয়েছে বাংলার জনতা। তাঁর যুক্তি ছিল, তার পরিষ্কার যুক্তি, ২০১৬ সালে বামফ্রন্ট-কংগ্রেস আসন সমঝোতা করেছিল। সাধারণ মানুষের কাছে বিকল্প রাস্তা তৈরি হয়েছিল। ফলস্বরূপ, ভোট কমে গিয়েছিল বিজেপির। কিন্তু , ২০১৯ সালে সেই ঘটনা ঘটেনি। বৃহস্পতিবার দিলীপ ঘোষের সিপিএম স্তুতির গাণিতিক কারণ এটি। ইয়েচুরি বলেছিলেন, সাধারণ মানুষকে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস বিকল্প রাস্তা দিতে পারেনি। উপরন্তু, ধর্মীয় মেরুকরণে ভোট ভাগাভাগি হয়ে যায় বিজেপি-তৃণমূলে। সেই, কারণেই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিজেপি-তৃণমূল শতাংশের হারে কাছাকাছি ভোট পেয়েছে – বিজেপি ৪০ শতাংশ। তৃণমূল ৪৩ শতাংশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 1 =