বিবস্বান বসু: বঙ্গ রাজনীতির ইতিহাস সাক্ষী থাকবে একুশের মহারণে সম্ভবত রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে ঐতিহাসিক জয় ছিনিয়ে এনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ কিন্তু তৃতীয়বারের জন্য বাংলার মসনদে আসীন হওয়ার লড়াইয়ে কত প্রতিকূল হার্ডল তাঁকে টপকাতে হয়েছে তার তত্ত্বতালাশ করতে গেলে বেশ ঘামই ঝরাতে হবে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
সারদা-নারদা-টেট-কয়লাপাচার-সিবিআই-ইডি-কাটমানি-সিন্ডিকেট, সব মিলিয়ে এক দশকের শাসনের পর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়ার মোকাবিলা করা তৃণমূল নেত্রীর কাছে নেহাত সহজ ছিল না৷ সহজ ছিল না তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগকে পুঁজি করে প্রকাশ্য মেরুকরণের রাজনীতির চ্যালেঞ্জ সামলানো৷ সহজ ছিল না দেশভাগের যন্ত্রণার ক্ষত বুকে নিয়ে বেড়ানো শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত উর্বর মাটিতে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের কার্পেট বম্বিংয়ের সামনে গড় রক্ষা করাও। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ধাক্কা আর দলবদলের হিড়িকে যখন মনে হচ্ছিল, তৃণমূলের বিদায়ের মঞ্চ তৈরিই রয়েছে, তখন ২০২১-এর বিধানসভা দখলের যুদ্ধের ফলাফল দেখাল, সব চ্যালেঞ্জ খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিয়ে বাংলার সবুজায়ন ঘটিয়ে দিয়েছেন মমতা। টানটান মর্যাদার যুদ্ধে তাঁর হার কাঁটার মতো বিঁধলেও, একাই তৃণমূলকে পৌঁছে দিয়েছেন ২১৩-য়। কিন্তু ‘সোনার বাংলা’ গড়ার লক্ষ্যে ঝাঁপানো বিজেপির সামনে তো ইস্যুর অভাব ছিল না। তা হলে কেন পদ্মে মজল না বঙ্গবাসীর মন? কেন মুখ থুবড়ে পড়ল গেরুয়া রথ?
ফলাফলের ময়নাতদন্ত বলছে, বিজেপি যখন পারসেপশন পলিটিক্সে ভর করে ‘আব কি বার ২০০ পার’-এর স্বপ্ন দেখিয়েছে, তখন তৃণমূল নেত্রী লড়েছেন একেবারে মা-মাটি-মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে। বরাবরই রাজপথের রাজনীতিকে প্রাধান্য দেওয়া মমতার জনকল্যাণমুখী উন্নয়নী উপহারের ডালি পৌঁছেছে আমজনতার দুয়ারে৷ তাই স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডে যেমন তৃণমূল ঘুরে দাঁড়ানোর অক্সিজেন পেয়েছে, তেমনই বিনামূল্যের চালে উপচে পড়েছে তাদের ভাতের হাঁড়ি৷ কন্যাশ্রী থেকে রূপশ্রী—মমতা যেমন পেয়েছেন মহিলাদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা-আশীর্বাদ, তেমনই ভোট ময়দানে তরতরিয়ে এগিয়েছে সবুজসাথীর সাইকেল। তৃণমূল নেত্রী বিজেপির গায়ে ‘বহিরাগত’ ছাপ সেঁটে দিতে যেমন লগ্নি করেছেন ‘বাংলার মেয়ে’র আবেগে, বাঙালিয়ানায়, তেমনই উচ্চগ্রামে নিয়ে গিয়েছেন এনআরসি-সিএএ বিরোধিতা আর জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির মতো আমজনতার ইস্যুকে৷ বিজেপির ডবল ইঞ্জিনের সরকারের ফানুসকে চুপসে দিতে যেমন সহানুভূতির তাস খেলেছেন, তেমনই তুলে ধরেছেন বাঙালির অস্মিতা।
মমতার খেলাটা অবশ্য সহজ করে দিয়েছে বিজেপিই৷ শুধু হাওয়ায় ভর করে যে ভোট জেতা যায় না, ভোটটা করানোর জন্য তৃণমূল স্তরেও সংগঠনটা প্রয়োজন, সেটা সম্ভবত ঠাহরই করতে পারেননি গেরুয়া নেতৃত্ব৷ ভূমিপুত্রের আড়ালে প্রকৃত বিকল্প মুখের অভাব থেকে ২৯৪ আসনে লড়াই করতে বহু ক্ষেত্রেই দলবদলু নেতাদের ওপর নির্ভর করা, বিজেপির বিরুদ্ধে গিয়েছে অনেক কিছুই। আর বিজেপি সবচেয়ে বেশি ফেঁসে গিয়েছে তাদেরই তৈরি করা মেরুকরণ নামক ফাঁদে। বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর চরিত্রের কথা মাথায় না রেখে প্রকাশ্য মেরুকরণের রাজনীতি বুমেরাং হয়ে গিয়েছে বিজেপির জন্যই।
হিন্দু ভোট তো একজোট হয়ইনি, বরং একচ্ছত্র সংখ্যালঘু ভোটের পুরোটার পাশাপাশি বড় অংশের হিন্দু-বাঙালি ভোটও তৃণমূলের বাক্সে জমা পড়ায় চওড়া হয়েছে দিদির হ্যাটট্রিকের হাসি৷ শুধু যে সংখ্যালঘু ভোট তাদের অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থে বিজেপিকে রুখতে এক ও একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে মমতাকে বেছে নিয়েছে তাই নয়, বিগত লোকসভা ভোটে যে বাম ভোট রামে গিয়েছিল, তার কিছুটা এবার বামে না ফিরে সরাসরি ঢুকেছে জোড়াফুলের ঘরে। যাঁরাই ‘নো ভোট টু বিজেপি’ স্লোগানকে বরণ করেছেন, তাঁরাই খুঁজেছেন মমতার পরশ৷ ফলে দিনের শেষে মমতার প্রত্যাবর্তনের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান। আর তারই মাশুল কড়ায়-গণ্ডায় গুনেছে বিজেপি।