নিজস্ব প্রতিনিধি: শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে তীব্র অস্বস্তিতে পড়েছে তৃণমূল। বলা যায় সরকারের মান সম্মান তলানিতে এসে ঠেকেছে। গোটা রাজ্যবাসীর মধ্যে এই ধারণাই হয়েছে যে তৃণমূল আমলে যাঁরাই চাকরি পেয়েছেন তাঁদের অধিকাংশ পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছেন। এই অবস্থায় মঙ্গলবার সাংবাদিক সম্মেলন করে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু যা বলেছেন তাতে তৃণমূল আগামী দিনে নতুন করে প্যাঁচে পড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। উল্লেখ্য ব্রাত্য বসু জানিয়েছেন রাজ্য সরকার নতুন করে পদ তৈরি করতে পারে যদি তাতে কলকাতা হাইকোর্ট অনুমতি দেয়।
শুধু তাই নয়, তিনি আরও বলেছেন যাঁরা ব্যতিক্রমী ভাবে চাকরিতে ঢুকেছেন তাঁদের সবাইকে যদি বসিয়ে দিতে বলে আদালত তবে সেটা করতেও রাজি আছে রাজ্য সরকার। এক্ষেত্রে রীতিমতো হোমওয়ার্ক করে ‘ব্যতিক্রমী ভাবে’ শব্দবন্ধটিকে ব্যবহার করেছেন ব্রাত্য। বিরোধীরা বলছেন আসলে শিক্ষামন্ত্রীর বলা উচিত ছিল টাকা দিয়ে বা সুপারিশের ভিত্তিতে যাঁদের চাকরি হয়েছে তাঁদের বসিয়ে দিতে রাজি আছে রাজ্য সরকার। এই পরিস্থিতিতে কলকাতা হাইকোর্ট যদি নতুন করে শূন্যপদ তৈরির অনুমতি দেয় তাতেও প্রশ্নের মুখে পড়বে রাজ্য সরকার। আবার সবাইকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দিলে তাতেও একই রকম ভাবে সমস্যা ফেস করতে হবে তৃণমূলকে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে যাঁরা চাকরি হারালেন তাঁদের সংসার চলবে কি করে! সবচেয়ে বড় কথা তখন তাঁরা টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন এই অভিযোগ মান্যতা পেয়ে যাবে। অর্থাৎ বিরোধীরা যে অভিযোগ করছেন যে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হয়েছে, আর সেই টাকা তৃণমূল নেতাদের পকেটে গিয়েছে বলে বিরোধীরা যে অভিযোগে সোচ্চার হয়েছে তখন সেটি আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে সকলের কাছে। অন্যদিকে আদালত যদি শূন্যপদ তৈরির নির্দেশ দেয় তাহলে বেআইনিভাবে যাঁদের নিয়োগ করা হয়েছে তাঁরা চাকরিতে বহাল থাকবেন। তখন আবার অভিভাবকরা প্রশ্ন তুলবেন যে সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে তাঁরা ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠাচ্ছেন তাঁরা কি আদৌ যোগ্য সেই পদের? অর্থাৎ ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে ওই শিক্ষকদের কাছে পড়তে পাঠিয়ে, এই অভিযোগ নিঃসন্দেহে তুলবেন অভিভাবকরা। সব মিলিয়ে এটা স্পষ্ট শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির প্যাঁচ থেকে তৃণমূলের মুক্তি পাওয়া বেশ কঠিন।
আর ঠিক এই কারণেই ত্রিপুরার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা চলে আসছে। বাম আমলে ত্রিপুরায় ১০৩২৩ জনকে শিক্ষকের চাকরি দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ পদ্ধতিগত ত্রুটির পাশাপাশি স্বজনপোষণের মাধ্যমে একটা বড় অংশ চাকরি পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ত্রিপুরা হাইকোর্টের নির্দেশে তাঁদের চাকরি চলে যায়। এরপর বিজেপি ত্রিপুরায় ক্ষমতায় এসে প্রতিশ্রুতি দেয় তারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হারানো চাকরি পুনরুদ্ধার করবে। সেই সূত্রে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় তারা। কিন্তু ত্রিপুরা হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট। সেই থেকে চাকরি হারানো ১০ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা ত্রিপুরা জুড়ে আন্দোলন করছেন। আর তাদের আন্দোলন ঠেকাতে বিজেপি শাসিত ত্রিপুরা পুলিশ অমানবিক ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ। যারা চাকরি হারিয়েছেন তাঁদের লাঠিপেটার পাশাপাশি সব রকম ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে বলে ত্রিপুরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। যে ঘটনা নিয়ে সরব হয়েছে বিরোধীরা। তাই প্রশ্ন কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের জেরে যদি পশ্চিমবঙ্গেও হাজার হাজার শিক্ষক শিক্ষিকা রাতারাতি বেকার হয়ে যান তখন ত্রিপুরার পরিস্থিতি বাংলাতেও দেখা যাবে না তো? সেই আন্দোলন থামাতে তৃণমূল শাসিত পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ একই রাস্তায় হাঁটবে? নাকি চুপ করে হজম করবে সেই আন্দোলন? প্রায় ১৩ লক্ষ টেটের খাতা অর্থাৎ ‘ওএমআর শিট’ যেভাবে নষ্ট করা হয়েছে তা নিয়েও মঙ্গলবার সিবিআই তদন্তে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। অর্থাৎ একের পর এক দুর্নীতির ফাঁসে আটকে পড়ছে তৃণমূল সরকার। ঠিক পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো ব্যাপার। দুর্নীতি যেন আর শেষ হয় না। সম্প্রতি আদালতে সিবিআই জানিয়েছে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি এমন পর্যায়ে গিয়েছে, যা দেখে সবাই শিউরে উঠবে। আর গোটা পরিস্থিতি যে সেদিকেই যাচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই জায়গা থেকে তৃণমূল আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।