তপন মল্লিক চৌধুরী : মোদী সরকারের আনা কৃষি বিল নিয়ে শুধু তো বিরোধিতা নয় সংসদে তাণ্ডব ঘটে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সেই বিল রাজ্যসভায় পাশও হয়েছে। তৃণমূল সহ বিরোধী গোষ্ঠী তো বটেই, এমনকি বিজেপির শরিক দল শিরোমনি অকালি দলও সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছে, মন্ত্রীত্ব ছেড়েছেন অকালি দলের হরসিমরত কউর বাদল।
তবে সরকারের আনা ‘কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন’, ‘অত্যাবশ্যক পণ্য আইন’, ‘কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিত রাখতে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ণ চুক্তি’- তিনটি বিলই লোকসভায় পাশ হয়েছে। এরপর রাজ্যসভায় ধ্বনি ভোটে দুটি বিল পাশ হয়েছে। সংসদের অন্দরে ও সংসদের বাইরে দেশ জোড়া প্রতিবাদের মধ্যে বিলগুলি পাশ হয়।
সরকারের দাবি, প্রান্তিক চাষিদের সুবিধা পাইয়ে দিতেই এই বিল। যে সমস্ত চাষিরা নিজেদের ফসল নিয়ে দরদাম করতে পারছেন না, তাঁদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, তাছাড়া এই বিল প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কৃষি পাইয়ে দিতে পারে বলে দাবি করছে সরকার। কেন্দ্র সরকার এও দাবি করছে, এই বিল মারফত ২০২২ সালে প্রতিটি কৃষকের আয় দ্বিগুণ হবে।
সরকার বলছে এই বিলের কারণে কৃষকরা তাঁদের ফসলের দাম আরও বাড়াতে পারবেন, তারা তাদের কৃষি পণ্য নিয়ে দরদাম করতে পারবেন। তাহলে প্রশ্ন কেন বিরোধিতা হচ্ছে বিলের? বিরোধিরা বলছেন, এই বিলের ফলে কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের ন্যূনতম সহায়কমূল্য পাবেন না। এই বিলের হাত ধরে বাজার থেকে সরকার নিয়ন্ত্রণ তুলে নিলে, কৃষকরা অসহায় হয়ে পড়বেন।
অন্যদিকে কৃষকদের আশঙ্কা, সরকার এই বিলের মাধ্যমে নূন্যতম সহায়ক মূল্যে তাঁদের থেকে ফসল কেনা বন্ধ করবে। ফলে ফের পুঁজিপতি ও কৃষি সংক্রান্ত খুচরো ব্যবসায়ীরা কৃষিবাণিজ্যের ওপর তাদের আধিপত্য বিস্তার করবে। ফলে দেশের কৃষক আরও গরিব হবেন। চাষিরা আশঙ্কা করছেন, কৃষিজাত পণ্য আরও মজুতকরণ হবে।
সরকারের নিয়ন্ত্রণের হাত সরে গেলে ভারতের কৃষি বাজারে ব্যবসার আস্ফালন বাড়বে। ফলে ব্যবসায়ীরাই আস্তে আস্তে পণ্যের দাম ঠিক করে দিতে শুরু করবে। যার ফলে কৃষক দাম চাইলেও তারা আর দাম পাবেন না। এছাড়াও কৃষিপণ্যে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ ঘিরেও আতঙ্কিত চাষিরা। বলা হচ্ছে, পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় মান্ডি ট্যাঙ্ক চালু রয়েছে। সরকারের নতুন বিলের হাত ধরে সেই মান্ডি ট্যাঙ্কে প্রচুর লোকসান হবে। কারণ কৃষক না চাইলে তিনি এখন থেকে মন্ডিতে ফসল নাও বিক্রি করতে পারেন। অন্যদিকে, ফসল বিক্রির ক্ষেত্রে কমিশন এজেন্টরা এর মধ্যে থাকতে পারছেন না। ফলে সমস্যার মেঘ গাঢ় হচ্ছে দুই রাজ্যের জন্য।
এনএসএসওর রিপোর্ট বলছে, ২০১২-১৩ সালের মধ্যে ১০ শতাংশেরও কম চাষি সর্বোচ্চ বিক্রয়যোগ্য দামে ফসল বিক্রি করতে পেরেছিল। দেশে মাত্র ৬ শতাংশ চাষি নিজের ফসলের সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য পায়। বাকি ৯৪ শতাংশ তা পায় না। আর নতুন কৃষি বিলের জন্য কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্যতে ৯৪ শতাংশ কৃষক সমস্যাতেই পড়বে বলে আশঙ্কা।
কৃষি বিলের বিরোধিতায় দিল্লির পাশাপাশি এ রাজ্যেও আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। তবে করোনা সংক্রমণ এড়াতে সামাজিক দূরত্ব বিধি মেনে কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এরপর দলের অন্য শাখার নেতা-কর্মীরাও এ নিয়ে কর্মসূচি পালন করবে বলে জানিয়েছেন তিনি। রাজ্য তথা দেশের সাধারণ মানুষ এবং বিজেপি বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দলকে আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
সংসদে কৃষকের স্বার্থ বিরোধী অভিযোগ তুলে বিল নিয়ে প্রতিবাদের সুর চড়িয়েছে কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলি। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী প্রশ্ন তোলেন, ‘ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) নিয়ে কেন কোনও গ্যারান্টির উল্লেখ নেই বিলে?’ জেডি(এস) নেতা এইচ ডি দেবেগৌড়া জানতে চান, কোভিড অতিমারীর মাঝে বিল পাশ করানোর এমন তাড়াহুড়ো কেন? তাছাড়া কৃষি বিল কৃষি সম্প্রদায়ের জন্য কী কী স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী সুবিধা দেবে, সে সম্পর্কে সবিস্তারে ব্যাখ্যা নেই। সেগুলি অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষঙ্গদের মতে, কেন্দ্র বলেছে, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হবে। কিন্তু বর্তমানের বাজারদরের ভিত্তিতে বলা যায়, ২০২৮ সালের আগে কৃষকদের রোজগার দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, দেশের গড় আয়ে ২০% অবদানকারী কৃষকদের কার্যত ক্রীতদাসে পরিণত করবে কেন্দ্রের এই তিন বিল। এই বিলের কারণে কৃষকরা মারা পড়বেন এবং তাঁদের পণ্যে রূপান্তর করা হবে।